জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ আমলে নিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। মামলার অপর দুই আসামী হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন।

গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয় এসব অভিযোগ। অভিযোগ আমলে নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এ মামলার অন্যতম আসামী পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন কারাগারে রয়েছেন। সেই সাথে আগামী ১৬ জুন পরবর্তী শুনানীর জন্য দিন ধার্য্য করেছেন।

ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ প্রথমবারের মতো সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এই বিচার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার শুরু করেছে। অন্যান্য টেলিভিশনও সম্প্রচার করে।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, গত বছরের জুলাই-আগস্টে চলমান গণআন্দোলনের সময় নির্বিচারে সহস্রাধিক মানুষ হত্যায় শেখ হাসিনা নির্দেশদাতা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সমর্থনে ১৩৫ পৃষ্ঠার মূল অভিযোগপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে আরও ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার তথ্যপ্রমাণ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিডিও, অডিও কল রেকর্ডিং, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবৃতি ও অন্যান্য দালিলিক উপাত্ত।

চিফ প্রসিকিউটর জানান, মামলায় তারা যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করবেন, তার মধ্যে রয়েছে- প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিকটিমদের সাক্ষ্য, ভিডিও ও অডিও ক্লিপস, সিসিটিভি ও ড্রোন ফুটেজ, ফরেনসিক বিশ্লেষণ, আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যচিত্র, আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট এবং সরকারি ডকুমেন্টস।

মামলার অন্যান্য দুই অভিযুক্ত হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, এই তিনজনের বিরুদ্ধে রয়েছে গণহত্যা, নির্বিচার হত্যা, উসকানি ও সহিংসতায় প্ররোচনার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

প্রসিকিউটর বলেন, ‘এই বিচার শুধু প্রতিশোধ নয়, এটি একটি জাতির ন্যায়ভিত্তিক পুনর্জাগরণের শপথ। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পথে ফিরে যাওয়ার জন্য এটি একটি ইতিহাস-গঠনকারী অধ্যায়।’

অভিযোগগুলো হলো, অভিযোগ-১ : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আসামী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আসামী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রনাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধগুলো সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ।

অভিযোগ-২ : আসামী শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্র জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন কর্তৃক আসামী শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীনস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে। যা তাদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।

অভিযোগ-৩ : শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে সরাসরি নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামীদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

অভিযোগ-৪ : শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ০৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ০৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামীদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

অভিযোগ-৫ : শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আসামী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আসামী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ০৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মরদেহ এবং ০১ জনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

আদালতে যা বললেন চীফ প্রসিকিউটর

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ‘মনসুন রেভুল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ চলাকালে সংঘটিত ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো আলোচিত মামলা ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম শেখ হাসিনা গং’। মামলার প্রথম দিনেই চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতে তার সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন, যা আদালত কক্ষে উপস্থিত সকলকে আবেগাপ্লুত ও স্তব্ধ করে দেয়।

প্রসিকিউটর বলেন, ‘আজ আমি শুধু একজন আইনজীবী নই, বরং ইতিহাসের তাজা রক্তাক্ত অধ্যায়ের এক সশ্রদ্ধ ভাষ্যকার। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যা ঘটেছে, তা ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক বধ্যভূমিতে।’

তিনি উল্লেখ করেন, এ মামলায় অভিযুক্তরা, যাদের নেতৃত্বে ও নির্দেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গ সংগঠন মিলে ব্যাপকভাবে হত্যা, অঙ্গহানি, নির্যাতন, গুম এবং চিকিৎসা-অধিকার হরণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে, তারা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

চিফ প্রসিকিউটর জানান, মামলায় তারা যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করবেন, তার মধ্যে রয়েছে- প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিকটিমদের সাক্ষ্য, ভিডিও ও অডিও ক্লিপস, সিসিটিভি ও ড্রোন ফুটেজ, ফরেনসিক বিশ্লেষণ, আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যচিত্র, আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট এবং সরকারি ডকুমেন্টস।

প্রসিকিউটর বলেন, এই বিচার শুধু প্রতিশোধ নয়, এটি এক জাতির ন্যায়ভিত্তিক পুনর্জাগরণের শপথ। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পথে ফিরে যাওয়ার জন্য এটি একটি ইতিহাস-গঠনকারী অধ্যায়।’

বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বর্ষা বিপ্লবের ভিকটিমদের, যারা ‘আর কখনও তাদের পরিবারের কাছে ফিরবেন না’, স্মরণ করেন সেই সব তরুণদের যারা চোখ, হাত, পা কিংবা শরীরের অঙ্গ হারিয়েছেন এবং স্মরণ করেন সেই সকল নির্ভীক মানুষদের, যাদের আত্মত্যাগের ফলে একটি নতুন ভোরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে উদ্ভূত হয় ব্যাপক ছাত্র-যুব আন্দোলন। কোটা সংস্কার, বৈষম্য ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আয়োজিত এ আন্দোলন ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামে পরিচিতি পায়। অভিযোগ রয়েছে, এই আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়ঙ্কর অপব্যবহার করা হয়, যার ফলে শত শত মানুষ নিহত ও নিখোঁজ হন, সহিংসতার শিকার হন হাজারো নিরীহ নাগরিক।

আন্তর্জাতিক মহলেও এ ঘটনাগুলো ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয় এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন ও বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের আওতায় এ বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।