মেট্রোরেলের পিলারের বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিহত আবুল কালাম আজাদের দুই শিশু সন্তান এখনো খুঁজছে তাদের প্রিয় বাবাকে। এই সন্তানরা জানে না তাদের বাবা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না! আজাদের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া আহাজারি করতে করতে বলেন, আমার সন্তানরা এখনও বুঝতে পারেনি, তাদের বাবা আর ফিরবে না। ওরা বলে, বাবা ঘুমাচ্ছে মা, তুমি কান্না করো না। আমি কীভাবে ওদের বোঝাই যে, ওদের বাবা আর কখনো জাগবে না! অত্যাধুনিক মেট্রোরেলের পিলার থেকে বেয়ারিং প্যাড পড়ে এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা কেউ মেনে নিতে পারছে না। নিহত আজাদের পরিবারে শোকের মাতম বইছে।
আইরিন আক্তার বলেন, আবুল কালামই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা, এখন আমি ও সন্তানরা একেবারে দিশেহারা হয়ে গেছি। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মেয়েটার চোখের সমস্যা ছিল, কয়েক দিন পরেই বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করার কথা ছিল। নিহত আবুল কালামের চাচাতো ভাই আব্দুল গণি চোকদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারের অবহেলার কারণে আমার ভাই মারা গেল। এখন এর দায় কে নেবে?
অন্যদিকে নিহত আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া বাদী হয়ে এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেছেন। গতকাল সোমবার তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, গত রোববার রাতে নিহত আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন।
এদিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিহত আবুল কালাম আজাদের (৪০) জানাজা গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে উপজেলার মোক্তারের চর পূর্ব পোড়াগাছা দাখিল মাদরাসা মাঠে নিহতের জানাজা শেষে তাকে নড়িয়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে রাত ১টার দিকে তার লাশ নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। আবুল কালামের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে এলাকাজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। অতি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও স্থানীয়রা। নিহত আবুল কালাম আজাদ ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির ছেলে। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। প্রায় ২০ বছর আগে তার বাবা ও মা মারা গেলে তিনি বড় ভাই ও বোনদের কাছে বড় হন। সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে তিনি মালয়েশিয়ায় যান এবং ফিরে এসে ২০১৮ সালে আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে ছয় বছরের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী এক মেয়েসন্তান রয়েছে। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায় বসবাস করতেন এবং ঢাকার মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতেন।
প্রতিদিনের মতো রোববার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে আসেন আবুল কালাম। এরপর কাজের জন্য সেখান থেকে বের হন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড হঠাৎ খুলে নিচে পড়ে যায়। সেটির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই আবুল কালাম আজাদ প্রাণ হারান। নড়িয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) লাকী দাস বলেন, আবুল কালামের মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে তার জানাজা ও দাফনে অংশ নিয়েছি। আমরা সার্বক্ষণিক তার পরিবারের পাশে রয়েছি। পরিবারের লোকজন যেকোনো প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসনকে পাশে পাবে। মেট্রোরেলের সহকারী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান জানান, তাকে মেট্রোরেলের পক্ষ হতে নিহতের পরিবারকে সমবেদনা ও দাফন কার্যক্রমে অংশ নিতে পাঠানো হয়েছে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ থেকে নিহতের পরিবারের জন্য সর্বোচ্চটুকু করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
মেট্রোরেলের স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বেগ: গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। তখন এই ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল প্রায় ১১ ঘণ্টা। এরপর রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেট এলাকায় আবারও বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান আবুল কালাম আজাদ। এ ঘটনার পর নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে মেট্রো ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও কাঠামোগত স্থায়িত্ব নিয়ে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরেও একই জায়গায় বিয়ারিং প্যাড খুলে গিয়েছিল। তখন প্রকৌশলী ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সম্ভাব্য নকশাগত ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করে সতর্ক করেছিলেন। দুইবারই বিয়ারিং প্যাড খুলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে মেট্রোরেল লাইনের একটি বাঁক অংশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল লাইনের বাঁকে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে এবং সেখানেই প্যাডটি খসে পড়েছে। নকশাগত ত্রুটি এর অন্যতম কারণ হতে পারে। বিয়ারিং প্যাড মেট্রোরেল কাঠামোর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ভায়াডাক্ট ও কলামের (স্তম্ভ) মাঝখানে বসানো হয়, যাতে কম্পন শোষণ, ভার বহন এবং কাঠামোর নমনীয়তা বজায় থাকে। এই প্যাডগুলো কেবল ট্রেনের ওজনই বহন করে না, বরং ট্রেন চলার সময় সৃষ্ট কম্পনও শোষণ করে। রেললাইনের বাঁকানো অংশে এর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেখানে পাশের ও নিচের দিকে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। এই অংশ নষ্ট হলে কাঠামোর ভারসাম্য নষ্ট হয়, ফলে ক্ষতি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়- যাত্রী ও পথচারী উভয়ের জন্যই।
দুর্ঘটনার পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। এ কমিটিতে থাকছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম, ডিএমটিসিএল-এর লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপ-সচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঁকানো স্থানে বিয়ারিং প্যাড স্থাপন আরও নিরাপদ করতে উন্নত প্রযুক্তি ও ধাতব-সংবলিত বা চাপ-সহনশীল উপকরণ ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। এছাড়া, অস্বাভাবিক নড়াচড়া শনাক্ত করতে মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন, বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা সার্টিফিকেশন, রক্ষণাবেক্ষণ নীতি ও বীমা কভারেজ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তারা।
এদিকে অত্যাধুনিক মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এভাবে মৃত্যুর ঘটনাটি অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারছে না। ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করে মতামত জানাচ্ছেন। অনেকেই মেট্রোরেল নির্মাণে দুর্নীতি এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কথা বলছেন। সামাজিকমাধ্যমে নিজের মত প্রকাশ করেন ঢালিউড অভিনেতা সিয়াম আহমেদ। নিজের ফেসবুক পেজে একটি দীর্ঘ পোস্ট করেন অভিনেতা সিয়াম আহমেদ। সেখানে তিনি লেখেন,‘ঢাকা মেট্রোরেল ট্র্যাজেডির ভয়াবহতা আমাকে অসাড় করে তোলে এবং সত্যি বলতে বীতশ্রদ্ধ করে। আমরা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ট্যাক্স দিই, যা আমাদের জীবনকে উন্নত করবে-ধ্বংস করবে না। অথচ আমার টাকায় এমন কিছু তৈরি করা হয়েছে, যা এক পরিবারের প্রিয়জনের জীবন কেড়ে নিয়েছে।’ তিনি আরও লেখেন,‘পরিহাসটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক- অন্য দেশে আপনি দুর্ঘটনাবশত রেললাইনের ওপর পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু এই অভিশপ্ত দেশে রেললাইন ও তার টুকরো আকাশ থেকে আপনার ওপর পড়ে যায়! এটি কোনো সৃষ্টিকর্তার কাজ নয়, এটি গাফিলতির মারাত্মক পরিণতি। অথচ সংশ্লিষ্ট সবাই দাবি করবে, তারা “ভুলভাবে তৈরি করেনি”, “ চেক করতে ভুলেনি”, কিংবা “দায় এড়ায়নি”।’
এর আগে ঘটনার পর নিহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে এক কোটি টাকা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ দাবি জানান তিনি। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড মেট্রোরেল সেবা চালু সংক্রান্ত একটি পোস্ট প্রদান করে, সেই পোস্টের কমেন্টে মাহবুব কবির মিলন এই মন্তব্য করেন। মাহবুব কবির মিলন লিখেছেন, নিহতের পরিবারকে দিতে হবে ১ কোটি টাকা। এই টাকা দেবে নি¤œমানের বিয়ারিং প্যাড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং অবহেলা ও ভাগ খাওয়া সরকারি কর্মকর্তারা। পোস্টের শেষে সিয়াম আহমেদ লেখেন,‘আমাদের শুধু সমবেদনা নয়, এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু প্রয়োজন। এ বিশাল ব্যর্থতার জবাব ও জবাবদিহিতা আমাদের দরকার।’
বিয়ারিং প্যাডের মান নির্ণয়ে হাইকোর্টে রিট: মেট্রোরেল ও দেশের ফ্লাইওভারের সব বিয়ারিং প্যাডের গুণগত মান নির্ণয়ে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। রিটে মেট্রোরেল ও সব ফ্লাইওভারে ব্যবহার করা বিয়ারিং প্যাডের গুণগত মান ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করতে একটি কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন জনস্বার্থে গতকাল সোমবার সকালে এ রিট দায়ের করেন। সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদনটির ওপর শুনানি হতে পারে।