দুদকের ৪৫২ মামলায় আসামী ১৭৪৩
‘নখদন্তহীন’ বলে আখ্যায়িত এক সময়ের দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক নতুন এক পরিবেশ পেয়েই গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। দুর্নীতি বিরোধী রাষ্ট্রীয় একমাত্র সংস্থা হিসেবে কাজের উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে হেটেছে দলীয় সংস্থার আদলে। ফলে দেশবিদেশের কাছে এই সংস্থাটির পরিচয় ঘটে ‘নখদন্তহীন’ বাঘ হিসেবে। সরকারের পরামর্শ ও মতামতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তাদের চাওয়া পাওয়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে নানা সমালোচনায় পড়ে সমূহ আস্থা হারিয়েছে বিগত আওয়ামীলীগ আমলে। দলীয় সংস্থায় পরিনত হওয়া এই দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি প্রকারান্তরে বিরোধী দলকে ঘায়েলেই মাঠে তৎপর ছিল বরাবর। সেই পরিবেশ আর পরিস্থিতি থেকে দুদকের রেহাই মেলে চব্বিশের জুলাই আগষ্টের গনআন্দোলনে। অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই দুদক সাজায়, কাজের পরিবেশ ফিরে পায় সংস্থাটি। অত:পর নিজের মতো করে চলা সংস্থাটি হেটেছে বড় বড় দুর্নীতিবাজদের পেছনে। সাফল্যও পেয়েছে বিগত এক বছরে। কিছু নজির স্থাপন করেছে, আস্থা ও ভরসার জায়গায় স্থান নিয়েছে।
বেড়েছে দুর্নীতি মামলা : ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি ২০২৫ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধের কারণে ৪৫২টি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জানতে চাইলে দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম এক বছরের পরিসংখ্যান তুলে ধরে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এই সময়ের মধ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৮৪৫টি। এরমধ্যে ৪৫২টি মামলা দায়ের করেছে। যেখানে আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দুইশর বেশি হেভিওয়েট ব্যক্তিকে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা এক হাজার ৭৪৩ জন। এ সময়ে চার্জশিটে দেওয়া হয়েছে ৩৪৮টি।
আকতারুল ইসলাম বলেন, এই মামলাগুলোর মধ্যে রাজনীতিক, প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের নাম রয়েছে।
দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে দুদক বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ৪৫১টি মামলা ও ৪০৩টি চার্জশিট দাখিল করে। আলোচ্য সময়ে এক হাজার ৯৮৪টি অভিযোগ অনুসন্ধান করে। ২০২৩ সালে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ৮৪৫টি অনুসন্ধান করে দুদক। ওই বছর কমিশন ৪০৪টি মামলা ও ৩৬৩টি চার্জশিট দাখিল করেছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দুদকের মামলায় প্রথমবারের মতো সরাসরি আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ দুই শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে। আসামিদের মধ্যে আরও রয়েছেন- সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সামরিক কর্মকর্তারা।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছরে এত বিপুল সংখ্যক মামলা ও চার্জশিট দাখিল করার নজির সংস্থার দীর্ঘদিনের ইতিহাসে নেই। কমিশন এবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে পেরেছে। এটিই সবচেয়ে বড় অর্জন।
ফাঁদে সফলতা ‘শূন্য’ : অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের হাতেনাতে ধরার একটি কার্যকর কৌশল হচ্ছে ফাঁদ মামলা। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ্যে আসে। তবে গত এক বছরে ফাঁদ মামলায় দুদক তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি। এক্ষেত্রে দুদকের অর্জন বলা যায় শূন্য।
গত সাত বছরের মধ্যে ফাঁদ মামলা সর্বনি¤œ পর্যায়ে নামে ২০২৪ সালে। গত বছর এরকম একটি মামলাও করতে পারেনি সংস্থাটি। এর আগে ২০২৩ সালে তিনটি, ২০২২ সালে চারটি, ২০২১ সালে ছয়টি, ২০২০ সালে ১৮টি, ২০১৯ সালে ১৬টি ও ২০১৮ সালে ১৫টি ফাঁদ মামলা করেছিল দুদক।
১১ মাসে জালে ফেঁসেছে ২৭৮৮ দুর্নীতিবাজ : ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত ১১ মাসে দুদক‘র জালে ফেঁসেছে রাঘব-বোয়ালসহ ২৭৮৮ জন দুর্নীতিবাজ। যারা সরাসরি অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিভিন্ন মামলা বা চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪৩২ জন মামলার ও ১৩৫৬ জন চার্জশিটভুক্ত আসামি। আর আসামিদের মধ্যে ৩৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ১১৪ জন, ৯২ জন রাজনীতিবিদ এবং ৭১৫ জন বেসরকারি চাকরিজীবীসহ অন্যান্য পেশার ব্যক্তিও রয়েছেন।
পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ১১ মাসে বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ১২ হাজার ৮২৭টি অভিযোগ দুদকে জমা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৬৮টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়। মাস হিসাবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বাধিক ৭০টি ও ৫৪টি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় আসামিদের মধ্যে ৩৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ১১৪ জন, ৯২ জন রাজনীতিবিদসহ ১২৬৪ দুর্নীতিবাজ দুদকের জালে। ওই সময়ে ২২৩ জনের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী নোটিশ দেয় দুদক। একই সময়ে ৯টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) হয়।
সাজার হার কমছে, বাড়ছে খালাস : গত এক বছরে দুদক‘র মামলায় সাজার হার কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০২৪ সালে বিচারিক আদালতে দুদকের মামলায় সাজার হার নেমে এসেছে ৪৮ শতাংশে, আর চলতি বছরের জানুয়ারি-জুলাই (৭ মাসে) এ হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ শতাংশ। অথচ ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সাজার হার ছিল ৬০ থেকে ৭২ শতাংশের মধ্যে।
দুদক থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালে বিচারিক আদালতে দুদকের ২৯৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশেষ জজ আদালতে ৯৯টি এবং ঢাকার বাইরে আদালতগুলোতে ১৯৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ১৫৭টিতে সবাই খালাস পেয়েছেন। বাকি ১৩৮টিতে সাজা হওয়া মামলার মধ্যে ঢাকায় ৫০টি এবং ঢাকার বাইরে আদালতগুলোয় ৮৮টি মামলার আসামিরা দন্ডিত হন।
গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে দুদকের ১৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি মামলায় সাজা হলেও বাকি ৭৪টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। অর্থাৎ, ৪৯ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে, আর ৫১ শতাংশ খালাস পেয়েছেন। এর আগে ২০২৩ সালে দুর্নীতির মামলায় সাজার হার ছিল ৬৭ শতাংশের বেশি। এর আগে ২০২০ সালে সাজার হার ৭২ শতাংশ, ২০২১ সালে ৬০ শতাংশ, ২০২২ সালে ছিল ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।
সাজার হার কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় যুগ আগে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় দুদকের করা হয়রানিমূলক মামলাগুলো থেকে গত এক বছরে অনেকেই খালাস পেয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দায়ের হওয়া দুদকের বহু মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন বেশকিছু রাজনীতিক। এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও হয়রানির জন্য দুদককে ব্যবহার করা হয় বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেন।
গণশুনানি দ্বিগুণ, প্রতিরোধেও জোর : দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করেছে দুদক। দুর্নীতি প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে গত বছরের তুলনায় এবার দ্বিগুণসংখ্যক জেলায় গণশুনানি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সংস্থাটি। গত বছর ১৪টি জেলায় গণশুনানি হওয়ার কথা থাকলেও ১২টিতে হয়। এ বছর ২৫টি জেলায় গণশুনানি আয়োজনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। দুদকের এই কর্মসূচি অর্থবছর অনুসারে হয়ে থাকে। গত জুলাই থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত ২৫টি জেলাকে গণশুনানির তালিকায় আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে গত ১০ ও ১১ আগস্ট বগুড়া ও জয়পুরহাটে দুটি গণশুনানি হয়েছে। সর্বশেষ গত রোববার সিরাজগঞ্জ ও গতকাল সোমবার টাঙ্গাইল জেলায় গণশুনানি করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিরোধ কার্যক্রমের গণশুনানি আয়োজন ছিল নগণ্য। গত ডিসেম্বরে কমিশন পুনর্গঠনের পর প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছর অর্থাৎ গত জুলাই থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত ২৫টি জেলায় গণশুনানির কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথমার্ধে বগুড়া ও জয়পুরহাটে গণশুনানি সফল করা হয়েছে। গণশুনানিতে জনসাধারণের সরাসরি উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে জয়পুরহাটে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ৩৩টি অনিয়ম-দুর্নীতিসংক্রান্ত ৬৭টি অভিযোগ এবং বগুড়ায় ৩২টি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিসংক্রান্ত ৯৭টি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা, ৮ সেপ্টেম্বর শেরপুর, ১২ অক্টোবর বরগুনা, ১৩ অক্টোবর ঝালকাঠি, ২৬ অক্টোবর যশোর, ২৭ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা, ৯ নভেম্বর পঞ্চগড়, ১০ নভেম্বর দিনাজপুর, ২৩ নভেম্বর সিলেট, ২৪ নভেম্বর হবিগঞ্জ, ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর, ২১ ডিসেম্বর ভোলা, ২৫ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুর, ৮ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ী, ২৬ ফেব্রুয়ারি নাটোর, ৮ মার্চ গাইবান্ধা, ৩১ মার্চ মেহেরপুর, ৫ এপ্রিল মাগুরা, ১৯ এপ্রিল ঢাকা ও ১০ মে রাজশাহী জেলায় গণশুনানির আয়োজন করা হবে।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৪টি জেলায় গণশুনানির তালিকা করেছিল দুদক। এর মধ্যে ১২ জেলায় গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সব গণশুনানিতে দুদকের পক্ষে দুই কমিশনার ও সচিব উপস্থিত হলেও তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান কোনোটিতেই উপস্থিত হননি। তবে বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান চলতি বছরের দুটি গণশুনানিতেই প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।