চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলীতে দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন ৬২২জন। এর মধ্যে এক চোখ চিরতরে হারিয়েছেন ৪৯৩ জন। আর দুই চোখের আলো নিভে যাওয়ায় ১১ জনের জন্যই এখন পৃথিবী অন্ধকার। দুই চোখে দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন ২৮ জন। আর ৪৭ জন এক চোখে গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন। তবে এক চোখে সাধারণ দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন ৪৩ জন। এমনকি দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন আরও অনেকে।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক জাকিয়া সুলতানা নীলার জবানবন্দীতে উঠে এসেছে এমন তথ্য। তিনি রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গতকাল সাক্ষ্য দেন ডা. নীলা। ২১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। শুনানির সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন পলাতক আসামী শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
সাক্ষীর ডায়াসে উঠে শুরুতেই নিজের পরিচয় দেন এই চিকিৎসক। এরপর জুলাই-আগস্টে তার প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেওয়া চোখ হারানোদের বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি। জবানবন্দীতে ডা. নীলা বলেন, ‘১৭ জুলাই থেকে আমাদের হাসপাতালে গুলীবিদ্ধরা আসতে থাকেন। ওই দিন গুলীবিদ্ধ পাঁচজন আসেন। আর ১৮ জুলাই দিনটি ছিল রক্তস্নাত দিন। সেদিন অপারেশন থিয়েটার বা ওটিতে ব্যস্ত ছিলাম। দুপুরের দিকে হাসপাতালে অনেক গুলীবিদ্ধ আহত এসেছেন বলে খবর আসে। তাদের চিকিৎসা দিতে হবে। আনুমানিক ১০০ রোগী ভর্তি হয়েছেন। আরও ১০০ জনকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগে যেতেই ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। অর্থাৎ গুলীবিদ্ধ হওয়া শতাধিক আহতকে দেখি। যাদের বয়স ১৪ থেকে ২৫ বছর। তাদের কেউ এক হাত দিয়ে এক চোখ, আবার কেউ দু-হাত দিয়ে দুই চোখ ধরে আছেন। যাদের সবার চেহারা রক্তস্নাত ছিল। ওই দিন রাত ৯টা পর্যন্ত ১০টি টেবিলে অস্ত্রোপচার চলে। পরদিনও একই চিত্র দেখতে পাই। সেদিনও সকাল ৮টা থেকে অস্ত্রোপচার শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশই মেটালিক পিলেট ও কেউ কেউ রিয়েল বুলেটে আহত ছিলেন। আহতদের ধরন ছিল কর্নিয়া ছিদ্র, চোখের সাদা অংশ ছিদ্র, চোখ ফেটে যাওয়া, রেটিনা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া ও চোখে রক্তক্ষরণ।
এই সাক্ষী আরও বলেন, ‘৪, ৫ ও ৬ আগস্টেও আমরা অসংখ্য আহতকে চিকিৎসা দেই। তাদের অস্ত্রোপচার করা হয়। এর মধ্যে ৪৯৩ জন এক চোখ চিরতরে হারিয়েছেন। ১১ জন দুই চোখ হারিয়ে অন্ধত্ব জীবনযাপন করছেন। দুই চোখে দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন ২৮ জন। আর ৪৭ জন এক চোখে গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন। তবে এক চোখে সাধারণ দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন ৪৩ জন।’
তিনি বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে কৌশল হিসেবে আহতরা নিজেদের আসল নাম গোপন করে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জবানবন্দীতে জানিয়েছেন ডা. নীলা। বলেন, অনেকেই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। কেউ মোবাইল নম্বর আবার কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও ভুল দিয়েছেন। এ সময় আহতদের ছবি-তথ্য সম্বলিত একটি পাওয়ার প্রেজেন্টেশন প্রদর্শন করা হয় ট্রাইব্যুনালে।
শেখ হাসিনার এ মামলায় ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা ছাড়াও আরও চারজন সাক্ষ্য দিয়েছেন গতকাল। এ পর্যন্ত এ মামলায় ২৪জন স্বাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আজ পরবর্তী স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
জুলাই আন্দোলনে শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা মো. ইদ্রিস একজন ফুচকা ও চটপটি বিক্রেতা। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল বাবাকে সাহায্য করতে। আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারায় মারুফ। ছেলের যেদিন গুলীবিদ্ধ হয় সেই দিনের বর্ণনা দিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দিয়েছেন তিনি।
মো. ইদ্রিস বলেন, ‘আমার ছেলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত। সময় পেলেই গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আমাকে সহযোগিতা করত। ১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টায় আমার ছেলে মারুফ আন্দোলনের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তার সঙ্গে ছিল তার মামা ফয়সাল। জুমার নামাজের পর তারা বাসায় ফিরে আসলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি।’ এ কথা বলেই তিনি কাঁদতে থাকেন। একটু স্থির হয়ে ইদ্রিস বলেন, ‘পরে সাড়ে ৩টায় আবার বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তার মামা আমাকে ফোন করে জানায় যে, রামপুরা ব্রিজের ওপর থেকে পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলী করছে। পৌনে ৬টার দিকে ফোন করে জানায়, মারুফ গুলীবিদ্ধ হয়েছে বাড্ডা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। তখন তাকে এএমজেড হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
ইদ্রিস বলেন, মারুফের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে নিতে বলে সেখানকার ডাক্তাররা। পথে রামপুরা ব্রিজের ওপর আওয়ামী লীগ, পুলিশ, বিজিবি মিলে আমার ছেলেকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আটকায়। তখন মারুফের অক্সিজেন লাগানো ছিল, সে বেঁচে ছিল। ১৫-২০ মিনিট ধরে আটকে রাখার পর পুলিশ জানায়, সে মারা গেছে, তাকে হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই। আমার ছেলের গুলীবিদ্ধ স্থানটি তখন গামছা দিয়ে প্যাঁচানো ছিল। পুলিশ রাইফেলের বাঁট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেটি দেখে। তখন আমাদের ছেলে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।’
তিনি বলেন, ‘সেখান থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় ছেলেকে। এরপর ৭টা ২০ মিনিটের দিকে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’ এরপর আবার কাঁদতে থাকেন মো. ইদ্রিস।
ইদ্রিস আরও বলেন, ছেলের লাশ নিয়ে যেতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পোস্টমর্টেম ছাড়া দিতে চায়নি। দুদিন পর ২১ জুলাই পোস্টমর্টেম করে আমার ছেলের লাশ হস্তান্তর করে। পুলিশি বাধার কারণে ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করতে দেরি হয়েছে। বাড্ডা থানার ওসি তার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন। পূর্ব বাড্ডার কবরস্থানে ছেলের লাশ দাফন করা হয়।
ছেলের হত্যাকা-ের জন্য নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, স্থানীয় এমপি ওয়াকিল উদ্দিন এবং মাঠে থাকা কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম ও বিজিবির রেদোয়ানের বিচার চান মো. ইদ্রিস।
গতকাল ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটসন পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম। এইসময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে জেরায় ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এদিকে এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গতকাল সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। তার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। গতকাল পর্যন্ত এই মামলায় ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে।
এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামী করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকা-ের ঘটনায়।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।