জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমাতচ্যুত শেখ হাসিনাসহ তিন আসামীর রায়কে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই দিনের (১৬ ও ১৭ নভেম্বর) ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি দেয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। এরআগে রায় ঘোষণার দিন লকডাউন কর্মসূচি দিয়েছিল নিষিদ্ধ দলটি। রায়কে ঘিরে গত কয়েকদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে ফ্যাস্টি সমর্থিত দুর্বৃত্তরা। ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলার সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি। এদিকে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল নিক্ষেপ করতে এলে গুলীর নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। পুলিশ বলছে- আতঙ্কের কিছু নেই। যারাই অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে গতকালও রাজধানীর কয়েকটি স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
এদিকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যাতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে জমায়েত হতে না পারে, সেজন্য সব থানাকে নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এর পাশাপাশি রেল ও নৌপথেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং পুলিশ সদস্যরাও সতর্ক রয়েছেন। এ অবস্থায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ হাইকোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দাবি, শাটডাউন ঘিরে কোনো ধরনের শঙ্কা নেই। পুলিশ জানিয়েছে, রোববার রাত থেকেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। সম্ভাব্য নাশকতা প্রতিরোধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল কার্যক্রম। মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মোতায়ের রয়েছে বিপুল সংখ্যা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে যে রায় হোক, তা কার্যকর হবে। অপরদিকে রায়কে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নাশকতা ঠেকাতে আবারও মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি দল। এছাড়া নাগরিক পার্টি ও জুলাই যোদ্ধাসহ আরও কয়েকটি সঘটন নাশকতা ঠেকাতে মাঠে থাকবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যপক তৎপরতার মাঝেও রাজধানীর হাজারীবাগ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও সাভারে তিনটি বাসে অগ্নিসংযোগ এবং ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হাতবোমার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার রাত থেকে গতকাল রোববার ভোর পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটলেও কোথাও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া গতকাল সকালে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডের ওয়াক্ফ ভবনের সামনে একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়ে এক পথচারী আহত হয়েছেন।
গতকাল রোববার বিকেলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ও হাইকোর্ট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, এপিবিএনসহ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রেখেছেন। প্রত্যেক সংস্থার সদস্যরাই সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের সামনে এবং মৎষ্য ভবন মোড়ে পুলিশের সাজোয়া যান দেখা গেছে। শেখ হাসিনার রায় ঘিরে কোনো ধরনের নিরাপত্তার শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনসহ সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় দেখামাত্র গুলীর নির্দেশ দেয়ার ব্যাপারে গতকাল বিকালে বেতার বার্তায় কমিশনার এমন নির্দেশনা দেন বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অপরাধ বিভাগের একজন উপকমিশনারসহ তিনজন কর্মকর্তা। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, আমি ওয়্যারলেসে বলেছি যে কেউ বাসে আগুন দিলে, ককটেল মেরে জীবনহানির চেষ্টা করলে তাকে গুলী করতে। এটা আমাদের আইনেই বলা আছে। জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচারের রায় ঘনিয়ে আসায় ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর বিক্ষোভ ও ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি দেয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা থাকা আওয়ামী লীগ। এই কর্মসূচি ঘিরে ১০ নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসে-ট্রেনে আগুন দেওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে আসছে। শেখ হাসিনার মামলার রায় সোমবার ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছে। এ দিনটি ঘিরে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ অনলাইনে রোববার থেকে দুই দিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। গত শনিবার রাত থেকেই ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী গণমাধ্যমকে বলেন, আমি ওয়্যারলেসে বলেছি যে কেউ বাসে আগুন দিলে, ককটেল মেরে জীবনহানির চেষ্টা করলে তাকে গুলী করতে। এটা আমাদের আইনেই বলা আছে। পুলিশের গাড়িতে আগুন দিলে, ককটেল নিক্ষেপ করলে বা জানমালের ক্ষতির চেষ্টা করলে পুলিশ তো বসে থাকবে না’ এমন মন্তব্য করেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি বলেন, দ-বিধির ৯৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগকালে কৃত কোনো কিছুই অপরাধ নহে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ১৭ নভেম্বর ঘিরে কোনো ধরনের নিরাপত্তার শঙ্কা নেই। তবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের শাটডাউন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ডিএপির পক্ষ থেকে সর্বাত্মক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। একই কথা জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের ফোর্স মোতায়েন আছে। কোনো ধরনের নিরাপত্তার শঙ্কা নেই। অন্যদিকে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ১৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলার সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তারা দায়িত্ব পালন করছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া বিভিন্ন মহাসড়কসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিজিবিও মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, জেলাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিশেষ টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া সন্দেহজনক কর্মকা- রোধে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া বিভিন্ন মহাসড়ক ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ পরিস্থিতিতে বিজিবি এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একযোগে কাজ করছে, যাতে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এমজেডএম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, র্যাব-২ ও ৩ এর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আশপাশে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের সদস্যরা টহল ও চেকপোস্ট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি অনলাইনে যেসব হুমকি আছে, সেগুলো আমাদের সাইবার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি আরও আশ্বস্ত করে বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ কোনো সংগঠন এই রায়কে ঘিরে কোনো ধরনের নাশকতার চেষ্টা করলে র্যাব সেটি নস্যাৎ করে দিতে প্রস্তুত আছে। নগরবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
যে রায় হোক কার্যকর হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে যে রায় হোক, তা কার্যকর হবে। গতকাল রোববার দুপুরে বরিশাল পুলিশ লাইন্সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এ কথা জানান। মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো কিংবা খুব মন্দ নয়, পরিস্থিতি মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে কোনো ধরনের সহিংসতা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটতে পারে সে ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, দেশে এখন সবাই নির্বাচনমুখী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক।