ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শাহরিয়ার আলম সাম্যকে ছুরিকাঘাত করে চলতি বছরের ১৩ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একদল দুর্বৃত্ত হত্যা করে।

মামলার আসামি মেহেদী, কবুতর রাব্বি ও রিপনরা যেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাঁজা বিক্রি না করে সেই লক্ষ্যে সাম্য ও তার বন্ধুরা নিষেধ করেছিল। এর কারনেই তাদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়। এই শত্রুতার জেরে পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাম্যকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর আখতার মোর্শেদ চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন। চার্জশিটে মেহেদী হাসানসহ সাত মাদক কারবারিকে আসামি করা হয়েছে। অপর দিকে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সুজন সরকার, তামিম হাওলাদার, সম্রাট মল্লিক ও পলাশ সরদার নামে চারজনকে মামলার দায় হতে অব্যাহতি দানের আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

গত ১৩ মে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাম্যকে ছুরিকাঘাত করে একদল দুর্বৃত্ত। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় রাত ১২টার দিকে সহপাঠীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাম্যকে মৃত ঘোষণা করেন। এঘটনায় ১৪ মে সাম্যের বড় ভাই শরীফুল ইসলাম শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গাজা বিক্রির দলনেতা মেহেদীসহ সাত জনের বিরুদ্ধে এ চার্জশিট তাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- মেহেদী হাসান, মো. রাব্বি ওরফে কবুতর রাব্বি, মো. রিপন ওরফে আকাশ, নাহিদ হাসান পাপেল, মো. হৃদয় ইসলাম, মো. হারুন অর রশিদ সোহাগ ওরফে লম্বু সোহাগ ও মো. রবিন।

মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলার বাদীর আপন ভাই এসএম শাহরিয়ার আলম সাম্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। অপরদিকে আসামি মেহেদী হাসান, রিপন, কবুতর রাব্বি, পাপেল, হৃদয়, রবিন, সোহাগরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চিহ্নিত মাদক বিক্রেতা। আসামি মেহেদী হাসান তাদের দল নেতা। উল্লেখিত আসামিরা মেহেদী হাসানের কাছ থেকে মাদকদ্রব্য গাঁজা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানে মন্দির গেট এলাকায় খুচরা বিক্রি করে। গাঁজা বিক্রি শেষে সবাই মেহেদীর কাছে গাঁজা বিক্রির টাকা জমা দিতো। ঘটনার পূর্বে আসামি রিপন ও রাব্বি মেহেদীকে ঠিকমত গাঁজা বিক্রির টাকা না দিয়া বলে যে, তাদের গাঁজা বিক্রির টাকা কিছু মাস্তানরা জোর পূর্বক নিয়ে যায়। যার কারনে তারা মেহেদীকে নিয়মিত গাঁজা বিক্রির টাকা দিতে পারেনা। আসামি মেহেদী হাসান তখন তার লোকজনদের এরকম পরিস্থিতি হলে সবাইকে একসঙ্গে প্রতিহত করার জন্য বলে এবং কয়েকজনকে সুইচ গিয়ার (চাকু) ও ইলেকট্রিক ট্রেজারগান কিনে দেয়। আসামি মেহেদী, কবুতর রাব্বি ও রিপনরা যেন উদ্যানে গাঁজা বিক্রি না করে সেই লক্ষ্যে সাম্য ও তার বন্ধুরা নিষেধ করেছিল। এর কারনেই তাদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়।

মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা আখতার মোর্শেদ উল্লেখ করেন, শাহবাগ থানাধীন মুক্ত মঞ্চের কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চিহ্নিত মাদক বিক্রেতা কবুতর রাব্বি চলতি বছরের ১৩ মে রাতে প্রতিদিনের মতো মুক্তমঞ্চের কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাঁজা বিক্রি করছিল। তখন তার হাতে একটি ইলেকট্রিক ট্রেজারগান ছিল। চিহ্নিত মাদক কারবারি মেহেদীর ছত্রছায়ায় কবুতর রাব্বি ট্রেজারগান ও সুইচ গিয়ার নিয়ে সব সময়ে চলাফেরা করে ও মাদক বিয়ি করে। কবুতর রাব্বির সঙ্গে পাপেল ও রিপন সব সময়ে থাকতো। ঘটনার দিনও তারা কবুতর রাব্বির সঙ্গে ছিল। ঘটনার দিন রাতে সাম্য একটি মোটর সাইকেলে তার দুই বন্ধুসহ মুক্ত মঞ্চের দিকে আসলে কবুতর রাব্বিকে ইলেকট্রিক ট্রেজারগান হাতে দেখতে পেয়ে সাম্য তাকে থামতে বলে। কবুতর রাব্বি মুক্ত মঞ্চ হতে ৩০/৩৫ গজ দূরে ঘটনাস্থল গোল পুকুর (পুরাতন ফোয়ারা) দিকে দৌড় দেয়। সাম্য তাকে মোটর সাইকেল করে ধাওয়া করলে গোল পুকুরের (পুরাতন ফোয়ারা) কাছে ধরে ফেলে এবং ইলেকট্রিক ট্রেজারগানটি নেওয়ার চেষ্টা করে। তখন ট্রেজারগানটি না দিলে সাম্য কবুতর রাব্বিকে চড়-থাপ্পর মারে। তখন কবুতর রাব্বির চিৎকারে পাপেল, মন্দিরের পাশে ক্যান্টিন থেকে রিপন, মেহেদী, সোহাগ, হৃদয় ও রবিনরা ঘটনাস্থলে এগিয়ে এসে সাম্য ও তার বন্ধুদের সঙ্গে তর্কা-তর্কি ও হাতা-হাতিতে জড়িয়ে পড়ে। তাদের ধস্তাধস্তিতে ঘটনাস্থল কালো পুকুর পাড়ে (পুরাতন ফোয়ারার) পাশে পূর্ব থেকে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারির একটি মোটরসাইকেল পড়ে গিয়ে লুকিং গ্লাস ভেঙ্গে গেলে উক্ত মোটরসাইকেলের একজন (পলাশ সর্দার) অন্যত্র গিয়ে মারামারি করতে বলে। মেহেদী মোটরসাইকেলের উক্ত ব্যক্তিকে (পলাশ) চোখে মুখে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে ফেলে। তা দেখে তাদের সঙ্গে থাকা অপর একজন (সম্রাট মল্লিক) এগিয়ে গেলে মেহেদীর কাছে থাকা সুইচ গিয়ার (চাকু) দিয়া তাকেও ডান পায়ের উরুতে ছুরিকাঘাত করে, এতে সে মাটিতে পড়ে যায়। একই সময়ে সাম্যর সঙ্গে হাতা-হাতিতে জড়িত পাপেলকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আসামি মেহেদী ভিকটিম সাম্যর বুকে ঘুষি মারে এবং কবুতর রাব্বির কাছে থাকা সুইচ গিয়ার (চাকু) দিয়ে সে সাম্যর ডান পায়ের রানে চাকু মারলে (ছুরিকাঘাত করলে) সেও মাটিতে পড়ে যায়। সাম্যর বন্ধুদের (রাফি, বায়েজিদ) সঙ্গে মোটরসাইকেলের অপর ব্যক্তির (লাল গেঞ্জি পরিহিত তামিম) মারামারি চলাকালে সবার চিৎকারে মন্দিরের ভেতরে থাকা লোকজন মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে এলে এবং আশ-পাশের আরো লোকজন ঘটনাস্থলের দিকে আসতে থাকলে ঘটনায় জড়িত আসামিরা দক্ষিণ দিকে দৌড়ে পালিয় যায়। মন্দিরের প্রবেশ গেইটের কাছে আগে থেকেই রাখা রিপনের ব্যবহৃত আরটিআর মোটরসাইকেলে করে কবুতর রাব্বিকে নিয়ে রিপন মন্দিরের উত্তর পূর্ব পাশে পিছন দিকে মেহেদীর গ্রিপে (আস্তানায়) পালিয়ে যায়। আসামি মো. মেহেদী হাসান, মো. রাব্বি ওরফে কবুতর রাব্বি, মো. রিপন ওরফে আকাশ, নাহিদ হাসান পাপেল, মো. হৃদয় ইসলাম, মো. হারুন অর রশিদ সোহাগ ওরফে লম্বু সোহাগ ও মো. রবিনরা পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে সাম্যকে খুন করে এবং তার সঙ্গে বন্ধু বায়েজিদ ও রাফিদেরকে মারধর করাসহ হত্যার হুমকি প্রদান করায় পেনাল কোডের ১৪৩/৩০২/৩২৩/৫০৬/৩৪ ধারার অপরাধ প্রাথমিক ভাবে সত্য বলে প্রমানিত হয়।

মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, সন্দিগ্ধ আসামি সুজন সরকারের সঙ্গে থাকা অপর লোকজন ঘটনাস্থলে এসে সাম্যকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলে সাম্য ও বন্ধুদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে এবং পরবর্তীতে সুজন সরকার যখন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারে সাম্য মারা গিয়েছে তখন সুজন সরকার তার ফেসবুক লাইভে এসে বলে সাম্যর বন্ধুরা যদি দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতো তাহলে এত রক্তক্ষরণে সাম্য মারা যেত না। যা ভাইরাল হয়। কিন্তু মারামারির সময় ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতি ছিল না বা আসামিদের সঙ্গে কোনো পূর্ব পরিচিত বা যোগসূত্র ছিল মর্মে প্রমান পাওয়া যায় নাই। আসামি সুজন সরকার তার গ্রামের ঠিকানায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করে। ঘটনার দিন ঢাকাতে তার ব্যক্তিগত কাজে এসেছিল এবং তার এক আত্মীয়ের বাসায় দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সন্ধ্যার পরে তার দুই আত্মীয়সহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে এসেছিল। ঘটনার পরে কালিমন্দিরের গেট দিয়ে বাসায় ফেরার পথে আহতদের ঘটনাস্থলে পড়ে থাকতে দেখে। পরের দিন সাম্যর মৃত্যুর সংবাদ জানতে পেরে সে তার ফেসবুকে উল্লেখিত ঘটনা পোস্ট করে। সাম্য’র বন্ধু আশরাফুল আলম রাফি ও আসামি সুজন সরকার একই গ্রামে হওয়ায় তাদের মধ্যে পূর্ব শত্রুতার কারনে সাক্ষীরা তাকে উক্ত ঘটনায় জড়িত মর্মে সন্দেহ করায় গ্রেফতার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তদন্তকালে উক্ত আসামি এই মামলায় জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রমান পাওয়া যায়নি।

ঘটনাস্থলে পথচারী হিসেবে- জব্দকৃত মোটরসাইকেলে থাকা তামিম, সম্রাট, পলাশরা, তাদের মোটরসাইকেলটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে মারামারিতে অংশগ্রহণকারী তাদের অপরিচিত আসামিদেরকে থামানোর চেষ্টা করলে তারাও আসামিদের হাতে জখমপ্রাপ্ত হয়। উপস্থিত সাক্ষীসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগত অন্যান্য লোকজন ঘটনাস্থলে এগিয়ে এলে ঘটনায় জড়িত আসামিরা দ্রুত পালিয়ে গেলেও তারা তিনজনও জখমপ্রাপ্ত অবস্থায় উক্ত স্থানে অবস্থান করে। উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী যারা সাম্যকে পূর্ব থেকে চিনতো তাদের পরামর্শে সাম্যর সঙ্গে থাকা সাক্ষী রাফি ও বায়েজিদ সাম্মুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন তামিম, সম্রাট ও পলাশ তুলনামূলকভাবে কম জখমপ্রাপ্ত হয়ে উক্ত স্থানে পড়ে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের পরামর্শে তারা তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল যোগে চিকিৎসার জন্য পান্থপথস্থ শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং একজন রাজা বাজার এলাকায় যায়। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী মোটরসাইকেল চালক নাসিরের ৯৯৯-এ দেওয়া সংবাদের প্রেক্ষিতে শাহবাগ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে সাক্ষীদের বক্তব্য শুনে প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতারে তৎপর হয়। তখন আসামি তামিম, সম্রাট ও পলাশদের শমরিতা হাসপাতাল ও রাজাবাজার এলাকা থেকে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করে। তদন্তকালে জানা যায়- আসামি মো. তামিম হাওলাদার, সম্রাট মল্লিক (২৮), ঢাকার গুলিস্তান ও ফার্মগেট এলাকায় ফুটপাতে ভ্যানগাড়িতে জামা-কাপড় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। আসামি মো. পলাশ সরদার (৩০) তার গ্রামের বাড়িতে রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করে। তারা পরস্পর ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ায় ফুটপাতে ব্যবসা শেষে রাতের বেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একত্রে ঘুরতে আসে এবং ঘটনাস্থলে মোটরসাইকেল রেখে গল্প করছিল। গ্রেফতারকৃত আসামি মো. তামিম হাওলাদার, সম্রাট মল্লিক ও মো. পলাশ সরদারের সঙ্গে ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামি মাদক বিক্রেতা মেহেদী হাসান ও তার দলীয় কোন সদস্যের পূর্ব পরিচয় ছিল না।

তা ছাড়াও সাম্য ও তার বন্ধু বায়েজিদ, রাফিদের সঙ্গেও কোনো পূর্ব পরিচয় ছিল না। এজাহারে বর্নিত ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা সংক্রান্তে কোনো সাক্ষ্য প্রমান পাওয়া যায়নি।

মামলার অভিযুক্ত আসামিদের হাত-হতে মৃত সাম্যকে রক্ষা করতে এসে তামিম হাওলাদার মাথায় ইটের আঘাত, সম্রাট পায়ে ছুরির আঘাত এবং পলাশের চোখে জখম হয়। তারা এই মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে মর্মে কোন তথ্য প্রমান পাওয়ায় যায়নি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর আখতার মোর্শেদ বাসসকে জানান, ঢাাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক শাহরিয়ার আলম সাম্যকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় সাতজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছি। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চারজনকে অব্যাহতি দানের আবেদন করা হয়েছে।