আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, তার স্ত্রী ও মেয়ের ব্যাংক হিসাবসহ তাদের ৪৪টি হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছে আদালত। এসব ব্যাংক হিসাবে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ ৯২ হাজার ৫৭৪ টাকা থাকার তথ্য দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রোববার ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।

দুদকের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, সংস্থার সহকারি পরিচালক আবুল কালাম আজাদ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এসব ব্যাংক হিসাবের মধ্যে আমুর ১৫, তার স্ত্রী সাঈদা হকের ১৩, মেয়ে সুমাইয়া হোসেনের ১৫ ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নামে ১টি হিসাব রয়েছে।

আবেদনে বলা হয়, আমির হোসেন আমুর বিরুদ্ধে ‘ঘুষ, টেন্ডার বাণিজ্য, টিআর/কাবিখাসহ সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, বিদেশে অর্থ পাচার, নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক, যা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ অবস্থায় তারা যেন অস্থাবর সম্পদ উত্তোলন, স্থানান্তর করতে না পারে সেজন্য ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন বলে আবেদনে তুলে ধরে দুদক।

গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দলটির অন্য নেতাদের মত আমুরও কোনো হদিস মিলছিল না। ওইদিন শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দ্বাদশ সংসদের ঝালকাঠিতে আমুর বাসবভনে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। পরে তার ওই বাসভবন থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ১৪ আগস্ট ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।

ষাটের দশকের ছাত্রলীগ নেতা আমির হোসেন আমু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বরিশাল থেকে প্রাদশিক পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর পাঁচবার এমপি হওয়া এই আওয়ামী লীগ নেতা সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঝালকাঠি-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমু ছিলেন বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালী, যশোর ও ফরিদপুর জেলার মুজিব বাহিনীর প্রধান। ১৯৭৮-১৯৮৬ সালে তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তাকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য করে নেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান আমু। দলের ২০০৯-১৪ মেয়াদের সরকারের একেবারে শেষ দিকে দপ্তর পুনর্বণ্টনে তাকে ভূমি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করলে আমির হোসেন আমুকে দেওয়া হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ২০২০ সাল থেকে ১৪ দলের সমন্বয়ক এবং মুখপাত্র হিসেবে আমু দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর আমির হোসেন আমু ও তাঁর মেয়ে সুমাইয়া হোসেনসহ চারজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। অন্য দুজন হলেন আমির হোসেন আমুর সহকারী একান্ত সচিব ফখরুল মজিদ মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী রাফেজা মজিদ।

গত বছরের ৬ নভেম্বর রাজধানীর পশ্চিম ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে আমির হোসেনকে আমুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন পুলিশ জানিয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের সমন্বয়ক।

স্ত্রী-কন্যাসহ আসামী সাবেক এমপি তানভীর ইমাম

আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম, তার স্ত্রী মাহিন ইমাম ও কন্যা মানিজা ইসমত ইমামের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রোববার দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

তানভীর ইমামের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় ৩০ কোটি ৬২ লাখ ৩ হাজার ৮৩৬ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ঢাকার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন। আরেকটি মামলায় তানভীর ইমামের সঙ্গে তার স্ত্রী মাহিন ইমামকে আসামী করা হয়েছে। এতে তাদের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৭ লাখ ৪৯ হাজার ৫৪৮ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান ঢাকার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এই মামলা দায়ের করেন। তৃতীয় মামলায় তানভীর ইমামের সঙ্গে তার মেয়ে মানিজে ইসমত ইমামকে আসামী করা হয়েছে। ১ কোটি ৮৭ লাখ ১৫ হাজার ৭১৭ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এই মামলা হয়েছে। দুদকের উপসহকারী পরিচালক ওয়াশকুরুনী বাদী হয়ে ঢাকার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দায়ের করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় এসব মামলা করা হয়েছে।

তানভীর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার থেকে জয়ী হলেও দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আর মনোনয়ন দেয়নি তানভীরকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মতো তানভীর ইমাম এবং তার পরিবারের দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামে দুদক। গতবছরের ৮ অক্টোবর দুদকের আবেদনে তানভীর ও তার স্ত্রী মাহিনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। এরপর এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি এই দম্পতি এবং তাদের মেয়ের ৬৯টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেয় আদালত।

তানভীর ইমাম, তার স্ত্রী মাহিন ইমাম এবং মেয়ে মানিজা ইসমত ইমামের নামে থাকা এসব হিসাবে ২০ কোটি ২৯ লাখ ৭৯ হাজার টাকা রয়েছে। এছাড়া তাদের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশও দিয়েছে আদালত।