# সমন্বয়কদের তুলে আনার প্রস্তাবটি ছিল ডিজিএফআইয়ের, বাস্তবায়নে ছিলেন ডিবির হারুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশেই হয়েছে জুলাই-আগস্ট গণহত্যা। গত বছরের (২০২৪) ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ফোনকলের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার শুরু করে।

গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দেন মামুন। তিনি বলেন, গত বছরের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আমাকে ফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।

সাবেক আইজিপি জানান, সে সময় তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে ছিলেন এবং তার সঙ্গে অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার উপস্থিত ছিলেন। নির্দেশনার বিষয়টি জানানোর পর প্রলয় কুমার ডিএমপি কমিশনারসহ সারাদেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেন। এরপর থেকেই আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়।

জবানবন্দীতে মামুন আরও বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, ফজলে নূর তাপস, সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননসহ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা প্রধানমন্ত্রীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্ররোচিত করেছিলেন।

জবানবন্দীর এক পর্যায়ে তিনি আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবার এবং দেশবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান।

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, জুলাই আন্দোলন দমনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রতিরাতে কোর কমিটির বৈঠক হতো। কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তাদেরকে তুলে আনার প্রস্তাবটি ডিজিএফআইয়ের ছিলো। কোর কমিটির এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ডিজিএফআই এবং সাবেক ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে তাদের আটক করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে আটক করে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয় এবং সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়।

এছাড়াও জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ‘ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীতে দু’টি গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। একটির নেতৃত্ব দিতেন হাবিব ও আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন মনির।’ জবানবন্দিতে এমনই তথ্য তুলে ধরেছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

জবানবন্দীতে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট গণভবনে বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির একটি বেঠক হয়। বেঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিজিএফআই-এনএসআই প্রধানসহ কমিটির ২৭ জন অংশ নেন। আমি নিজেও ওই বৈঠকে ছিলাম। সেখানে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে বৈঠকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর মধ্যেই চারদিকের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় বেঠক মুলতবি করা হয়।

মামুন বলেন, ওই রাতেই আমাদের আবার গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আনিসুল, কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, র‌্যাব ডিজি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানাও ছিলেন। আর বাইরে অপেক্ষমান ছিলেন ডিজিএফআই ও এসবিপ্রধান। ওই বেঠকে ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ-সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে ফোর্স মোতায়েন করে কাঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় আমরা চলে আসি।

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট সকালে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দপ্তরে যাই। এর মধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা প্রবেশ করতে থাকে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা আমরা জানতাম না। এরপর বিকেলে আর্মির হেলিকপ্টার এসে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবিপ্রধান মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন। পরের ধাপে হেলিকপ্টারে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যান্যদেরও সেখানে নিয়ে আসা হয়।

এই রাজসাক্ষী বলেন, ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে আমার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয়। ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন ৩ সেপ্টেম্বর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আমরা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাই। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও প্রদর্শন করেন ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল। ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলেন যে, গুলি করি, একজন মরে, একজন আহত হয়। সেই যায়। বাকিরা যায় না।

ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দিতে মামুন বলেন, ‘আমি বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে ১৯৮৬ সালের ২০ ডিসেম্বর যোগদান করি। বিভিন্ন পর্যায়ে পুলিশের দায়িত্ব পালনের পর ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, র‌্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমাকে দুইবার চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আমি মোট ২২ মাস আইজিপি’র দায়িত্ব পালন করি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ছাত্রজীবনে সক্রিয় রাজনীতি করিনি। তবে আমার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমার বাবা সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার সুনাম এবং সরকারের প্রতি আমার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশের ডিআইজি, সিআইডি-এর প্রধানসহ র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব প্রদান করে। পরবর্তীতে পুলিশ বাহিনীতে গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ দেখা দেয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমার সততা, দক্ষতা বিবেচনাক্রমে আইজিপি হিসেবে আমাকে নিয়োগ প্রদান করেন। পুলিশ বাহিনীর সুনাম এবং অফিসারদের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব যাতে দেখা না দেয়, সেজন্য আমাকে পরবর্তীতে দুইবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক বিভিন্ন বলয় তৈরি হয়। রাজনৈতিক বিষয় এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়েন। সিনিয়র অফিসার হিসাবে আমার মতো পুলিশ কর্মকর্তাদের বাহিনীকে কন্ট্রোল করার সুযোগ সীমিত ছিল। রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকায় বিতর্কিত পুলিশ অফিসাররা স্বাভাবিক আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যাপক তৎপর ছিল।’

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় আমি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী রাতের বেলায় ব্যালট বক্সে প্রায় ৫০%-এর মতো ভোট রাখার পরামর্শ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেন বলে শুনেছি। মাঠ পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে রাতে ব্যালট বক্সে ভোট দেয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা প্রেরণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা ও উদ্যোগে জেলা প্রশাসন, ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, এসপি ও থানার ওসিরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে পুলিশের বিপিএম ও পিপিএম পদক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচনসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় পুলিশ অফিসারদেরকে বিবেচনা করা হতো। এক্ষেত্রে সঠিকভাবে পেশাদারিত্ব দেখানো হয়নি।’

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের পর পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব আরো বেশি বৃদ্ধি পায়। কিছু পুলিশ অফিসার প্রভাবশালী পুলিশ অফিসার হিসেবে স্বীকৃতি পান। এসব অফিসারদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তারাও তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখতেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় রাতের বেলা নিয়মিত বৈঠক হতো, যা গভীর রাত পর্যন্ত চলতো। মন্ত্রীর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিলো ডিএমপি কমিশনার হাবিব, ডিবি’র হারুন অর রশীদ, এসবি’র মনিরুল ইসলাম, ডিআইজি’র নুরুল ইসলাম, বিপ্লব কুমার, এডিশনাল এসপি কাফি, ওসি মাজাহার, ওসি ফরমান, ওসি অপূর্ব হাসানসহ আরো বেশ কিছু অফিসারের। এরা কেউই আমার বা আইজিপি’র নির্দেশ সঠিকভাবে মানতেন না। তারা মনে করতেন রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীসহ সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের কারো কারো ভালো সম্পর্ক ছিলো। আইজিপি হিসেবে আমি চাইতাম-পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশে গোপালগঞ্জ জেলার অবস্থান বেশ শক্ত। অফিসার ও ওসি পর্যায়ে গোপালগঞ্জ জেলার প্রাধান্য ছিলো। তারা সাধারণত কমান্ড মানতেন না এবং নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতেন। এদের বিষয় সাধারণত দেখতেন তৎকালীন এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম ও পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। ঢাকার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ অফিসার ছিলেন। পুলিশের মধ্যে অ্যাডিশনাল আইজিপি, তৎকালীন এসবি প্রধান মনিরুল ও কমিশনার হাবিবের মধ্যে সখ্য ছিলো। তারা আলাদাভাবে তাদের লোকজন ও সমমনা পুলিশ অফিসারদের মেইনটেন্স করতেন। পুলিশ বাহিনীর ইমেজ রক্ষায় ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে আমাকে আইজিপি হিসেবে পরবর্তীতে দুইবার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করা হয়।

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, ‘২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় আমি র‌্যাবের মহাপরিচালক ছিলাম। র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকার কারণে আমি জানি যে, টিএফআই সেল র‌্যাবের সদর দফতরের অধীনে পরিচালিত হতো। এটির অবস্থান হলো উত্তরার র‌্যাব-১ এর কম্পাউন্ডের ভেতরে। এছাড়াও র‌্যাবের ইউনিটগুলোর অধীনেও আলাদা আলাদা সেল/বন্দিশালা ছিলো। যেগুলো সংশ্লিষ্ট র‌্যাব ইউনিটগুলোর কমান্ডারদের অধীনে পরিচালিত হতো। র‌্যাব কর্তৃক রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা এবং গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার বিষয়টি র‌্যাবের ভেতরে একটা কালচার হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এই কাজগুলো প্রধানত র‌্যাব (অপারেশন্স) এবং র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকরা সমন্বয় করতেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘র‌্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসতো বলে শুনেছি। আমার সময় আমি এই ধরনের আদেশ পাইনি। কিছু কিছু নির্দেশনা তৎকালীন নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকির পক্ষ থেকে আসতো বলে জানতে পারি। র‌্যাব যদিও পুলিশের আইজি’র অধীনে ছিলো, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড মানা হতো না এবং র‌্যাবের প্রধানরা আইজিপিকে উপেক্ষা করেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে কাজ করত।’

জুলাই আন্দোলন প্রসঙ্গে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতেই নিয়মিত কোর কমিটির মিটিং হতো। আমি কোর কমিটির সদস্য হিসেবে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতাম। সেখানে স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত সচিব রাজনৈতিক টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তাফা, তৎকালীন এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, র‌্যাবের ডিজি ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, বিজিবি’র ডিজি মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকি, আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক, তৎকালীন এনটিএমসি’র ডিজি মেজার জেনারেল জিয়াউল আহসান ও ডিজিএফআই প্রধান উপস্থিত থাকতেন। সেখানে আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো।’

তিনি বলেন, কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়দের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ডিজিএফআই এবং তৎকালীন ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে তাদের আটক করার দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে আটক করে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয় এবং সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদের আত্মীয়-স্বজনকেও নিয়ে আসা হয়। সমন্বয়কদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য টেলিভিশনে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হয়। কোর কমিটির মিটিংয়ে তাদেরকে আটকের বিষয়ে আমি বিরোধিতা করি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে তাদেরকে আটক করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামালের সঙ্গে ডিবি প্রধান হারুনের গভীর সম্পর্ক ছিলো। হারুনকে জিন নামে ডাকতেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি হারুনকে খুব কর্মতৎপর এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে খুব কার্যকর মনে করতেন।