চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জোবরা গ্রামের অস্ত্রধারী স্থানীয় সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় আট যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে হাটহাজারীর ফতেপুর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফার করা হয়। চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ জানান, গ্রেফতারদের মধ্যে তিনজন এজাহারভুক্ত আসামি। তারা হলেন- ইমরান হোসেন এমরান (৩৫), মো. হাসান (২২) এবং রাসেল ওরফে কালা রাসেল (২৫)। বাকি পাঁচজনকে প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন-মো. আলমগীর (৩৫), নজরুল ইসলাম (৩০), মো. জাহেদ (৩০), মো. আরমান (২৪) ও দিদারুল আলম (৪৬)।

ঘটনার জেরে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) আব্দুর রহিম হাটহাজারী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৮০০ থেকে ১ হাজার জনকে আসামি করা হয়।

এদিকে এই ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত ও দায় নির্ধারণে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য সরকারকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬৩তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে রাতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, সংঘর্ষের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং দায়ীদের শনাক্ত করতে সরকারের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের অনুরোধ জানানো হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যারা প্রাপ্ত সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখতে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং স্থানীয় নিরীহ মানুষের ক্ষয়ক্ষতির জন্য সরকারকে ক্ষতিপূরণের অনুরোধ করা হবে।”

সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়-সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। ক্যাম্পাস এলাকায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা জোরদারে মডেল থানা ও নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করা হবে। শিক্ষার্থী-আবাসন সমস্যা সমাধানে কটেজ মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ভাড়া কমানো ও বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা সেবা জোরদারে দুইটি অ্যাম্বুলেন্স কেনা ও ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রকল্প (ডিপিপি) সরকারের কাছে পাঠানো হবে। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে পাঁচটি ছাত্র হল ও পাঁচটি ছাত্রী হল নির্মাণের জন্য নতুন প্রকল্প প্রেরণ করা হবে। বিদ্যমান আবাসিক হলগুলোর সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। পাশাপাশি ক্যাম্পাস-সংলগ্ন এলাকায় একটি মডেল থানা করারও প্রস্তাব করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন ও নিয়মিত টহল চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে অনুরোধ জানানো হবে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াহইয়া আখতার, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খান ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক কামাল উদ্দিন সভায় উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে গুরুতর আহত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ইমতিয়াজ আহমেদ চারদিন ধরে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। তার চেতনার মান (কনশাস লেভেল) এখনো ৬-এর আশপাশে রয়েছে, যেখানে স্বাভাবিক মানুষের মাত্রা ১৫। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এটি ১০-এর ওপরে না ওঠা পর্যন্ত তাকে আশঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। ইমতিয়াজের শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য গতকাল বুধবার পার্কভিউ হাসপাতালে মেডিকেল বোর্ড গঠিত হয়। ইমতিয়াজের ভাই আসাদুজ্জামান সজীব জানান, “আমরা আইসিইউর ভেতরে যাইনি। বাইরে থেকেই খোঁজখবর নিচ্ছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুপুরে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হবে।”

আহত সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র মামুন মিয়া বর্তমানে আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে আছেন এবং শিগগিরই তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হতে পারে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পার্কভিউ হাসপাতালের উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, “ইমতিয়াজের বিষয়ে দুপুরে মেডিকেল বোর্ড বসেছে। মামুনের অবস্থা আগের তুলনায় ভালো। তাকে কেবিনে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।”

গত ৩০ আগস্ট রাতে চবি দুই নম্বর গেট এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় প্রবেশ নিয়ে এক ছাত্রী ও নিরাপত্তারক্ষীর মধ্যে বাকবিত-া থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। পরদিন রোববার সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর ছদ্মবেশে অস্ত্রধারী স্থানীয় সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। আহতদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির কয়েকজন সদস্য ও এক উপ-উপাচার্যও রয়েছেন। সংঘর্ষের দ্বিতীয় দিনে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় রোববার দুপুর ২টা থেকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন।