বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর জবানবন্দী দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেওয়া এ জবানবন্দীর অংশ হিসেবে তিনি ১৭টি ভিডিও উপস্থাপন করেন এবং সেগুলো দেখানো হয়। এসব ভিডিওতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ভয়ংকর ও নৃশংস দৃশ্য ফুটে উঠেছে। অমানবিক ও হৃদয় বিদারক ঘটনার দৃশ্যে ট্রাইব্যুনালে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

গতকাল রোববার দুপুর সোয়া ১২টার পর থেকে ট্রাইব্যুনালে ৫৪তম সাক্ষী আলমগীর জবানবন্দী দেওয়া শুরু করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। দুপুর পৌনে ২টার দিকে ট্রাইব্যুনাল বিরতিতে যান। পরে আবার জবানবন্দী নেওয়া শুরু হয়। গতকাল স্বাক্ষ্য গ্রহণ শেষ না হওয়ায় আজ আবার তার স্বাক্ষ্য গ্রহণ হবে। এই সাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষী শেষ হবে। পরবর্তীতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর রায় ঘোষনা করা হবে বলে ট্রাইব্যুনাল থেকে জানা গেছে।

জবানবন্দী গ্রহণের শুরুতে তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর শপথ পড়ে ট্রাইব্যুনালে নিজের পরিচয় দেন। তারপরই প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, জবানবন্দীর সময় কিছু ভিডিও দেখানোর প্রয়োজন হবে। সেসব ভিডিও একসঙ্গে শুরুতেই দেখাতে চাইলে ট্রাইব্যুনাল সম্মতি দেয়। এরপর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আবু সাঈদ হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনার ১৭টি ভিডিও দেখানো হয়। এসব ভিডিওতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ভয়ংকর বা নৃশংস দৃশ্য ফুটে উঠেছে। প্রথমেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি ভিডিও প্রদর্শিত হয়। একপর্যায়ে একে একে সব দেখানো হয়। এর মধ্যে গত বছরের ১৪ জুলাই আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি আখ্যায়িত করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের চিত্রও তুলে ধরা হয়।

এছাড়া, রংপুর-রাজধানীর চানখারপুলে চালানো পুলিশের পাশবিকতার ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। এমনকি আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর সেই হৃদয়বিদারক ঘটনাটিও ফুটে ওঠে। সবশেষ গত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের চালানো হত্যাযজ্ঞ নিয়ে বানানো একটি প্রামান্যচিত্র দেখানো হয়। আর এসব ভিডিও প্রদর্শনী বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, জবানবন্দীর সময় ট্রাইব্যুনালের সম্মতি নিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন ঘটনার ১৭টি ভিডিও দেখানো হয়। এ বিচার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক আলমগীর। তিনি এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আরও দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন। রোববার তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

এর আগে গত বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ৫৩তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন এ মামলার বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা। তিনি জানান, শেখ হাসিনার ফোনালাপের ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং তিনটি মোবাইল নম্বরের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ফোনালাপ বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ বাজিয়ে শোনানো হয়। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার এ চারটির ফোনালাপের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও তার আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে একটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে দুটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের সঙ্গে একটি ফোনালাপ রয়েছে।

এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপ-পরিচালক আলমগীর। সার্বিক সহযোগিতা করেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা জোহা।

তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর গত ১২ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। ১০ জুলাই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। এ মামলার আসামী সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে রাজসাক্ষী হিসেবে আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ৩ আগস্ট থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।