মিয়া হোসেন : পবিত্র মাহে রমযান শুরু হয়েছে। আজ রোববার প্রথম দিন। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে মুসলিম উম্মাহর কাছে বছর ঘুরে আবার এসেছে পবিত্র মাহে রমযান। পবিত্র কুরআন নাযিলের এ মাসটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ এ মাসে মুসলমানদের জন্য বিশেষ রহমত ও করুণা ঘোষণা করেছেন। দীর্ঘ এগারটি মাসের পাপ থেকে মুক্তির সুযোগ এনে দেয়া হয়েছে এ মাসে। পবিত্র রমযানে রোজা পালন করা বাধ্যতামূলক হওয়ায় একটি নিয়মের মধ্য দিয়ে গোটা মাসটি পালিত হয়ে থাকে। যা মুসলিম সমাজ ও ইসলামী জীবন ধারায় এক বিরাট সাফল্যের সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের জন্য রমযান মাসে‘ রোজা পালন করা ফরজ করা হয়েছে। আত্মশুদ্ধির জন্য এ মাসটি একটি বিশেষ নেয়ামত।
রমযান আরবী শব্দ। অর্থ দহন। ইসলামী বিশ্বকোষে রমযান অর্থ গ্রীষ্মের উত্তাপ উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী বছরের নবম মাস হিসেবেই এর পরিচয় রয়েছে। রমযান মাসেই পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য, হেদায়েতেদের জন্য।
আল্লাহ পাক রমযান মাসের রোজা ফরয করেছেন এবং এর রাতগুলোতে আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে নফল ইবাদত রূপে সুনির্দিষ্ট করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর‘ রোজা ফরয করা হয়েছে যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সুরা বাকারা-১৮৩)
এ আয়াত প্রমাণ করে রোজা আমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও ফরয ছিল। হাদীস শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ রাতে আল্লাহর রেজামন্দি, সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশে কোন ওয়াজিব, সুন্নাত বা নফল আদায় করবে, তাকে এর জন্য অন্যান্য সময়ের ফরয ইবাদততুল্য সওয়াব প্রদান করা হবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে কোন ফরয আদায় করবে, সে অন্যান্য সময়ের সত্তরটি ফরয ইবাদতের সমান সওয়াব লাভ করবে। এ মাস ধৈর্য তিতিক্ষা ও সবরের।
ধৈর্য্যের প্রতিফল হিসেবে আল্লাহর নিকট থেকে জান্নাত লাভ করা যাবে। এটা পরস্পর সৌজন্য ও সহৃদয়তা প্রদর্শনের মাস। এ মাসে মুমিন বান্দাদের রিযিক প্রশস্ত করে দেয়া হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি কোন‘ রোজাদারকে ইফতার করাবে এর বিনিময়ে তার গুণাসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং জাহান্নাম হতে তাকে মুক্তি ও নিষ্কৃতি দেয়া হবে। আর তাকে আসল‘ রোজাদারের সমান সওয়াব দেয়া হবে। তবে সেজন্য আসল‘ রোজাদারের সওয়াব বিন্দুমাত্র কম করা হবে না। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা আরয করলাম ইয়া রাসুলুল্লাহ। আমাদের মাঝে সকলেই‘ রোজাদারকে ইফতার করাবার সামর্থ্য রাখে না এমতাবস্থায় তারা কিভাবে এই পুণ্য লাভ করবে? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি‘ রোজাদারকে একটা খেজুর, দুধ বা এক ঢোক সাদা পানি দ্বারাও ইফতার করাবে, তাকেও আল্লাহ পাক এই সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি একজন‘ রোজাদারকে পূর্ণমাত্রায় পরিতৃপ্ত করবে আল্লাহ পাক তাকে হাউজে কাউসার হতে এমন পানীয় পান করাবেন যার ফলে জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না।
এটা এমন এক মাস যে, এর প্রথম দশ দিন রহমতের ঝর্ণা ধারায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় দশ দিন ক্ষমা ও মার্জনার জন্য সুনির্দিষ্ট এবং শেষ দশ দিন জাহান্নাম হতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের উপায়রূপে নির্ধারিত। আর যে ব্যক্তি এ মাসে নিজের অধীনস্থ লোকদের শ্রম ও মেহনত হ্রাস বা হালকা করে দেবে, আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করবেন এবং তাকে জাহান্নাম হতে নিষ্কৃতি ও মুক্তিদান করবেন। আল্লাহ পাক এর মহান বাণী পবিত্র আল কুরআনসহ আসমানী কিতাবসমূহ এই মাসে নাজিল হয়েছে। এই মাসেই রয়েছে পবিত্র লাইলাতুল কদর। যার মূল্য হাজার মাস ইবাদতের ঊর্ধ্বে। এই মাসের প্রথম দশ দিন রহমতের বারিধারায় অবগাহন, দ্বিতীয় দশ দিন মাগফিরাত ও ক্ষমার আলোকে উদ্ভাসিত, আর শেষ দশ দিন জাহান্নাম হতে মুক্তি ও নিষ্কৃতির সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ লাভ করে ধন্য হওয়ার কামনা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের অন্তরে থাকা প্রয়োজন।
রোজার ঐতিহাসিক তাৎপর্য
রোযা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। আদি কাল থেকেই‘ রোজা মানুষের আত্মশুদ্ধির পথ হিসেবে প্রচলন আছে। যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন- হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর‘ রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববরতীদের ওপর,যাতে তোমরা তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।” এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে,‘ রোজা পূর্ববর্তী যুগেও ফরজ ছিল। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুসারে‘ রোজার ইতিকথা নিম্নে তুলে ধরা হলো,
হযরত আদম (আ.)-এর যুগে‘ রোজা
পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম কে‘ রোজা রেখেছিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে হযরত খিযির ইবনে হুবাইশ (রহঃ) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- আইয়্যামে বীজ কি? উত্তরে তিনি বললেন-আল্লাহ পাকের নিষিদ্ধ ফল খেয়ে হযরত আদম (আ.) জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরিত হন এবং তাঁর দেহের রং পরিবর্তন হয়ে যায়। তাঁর এই অবস্থায় ফেরেশতাগণ আল্লাহর সমীপে কান্নাকাটি করে হযরত আদম (আ.)-এর মুক্তি কামনা করেন। ফলে আল্লাহ পাক হযরত আদম (আ.)-এর নিকট এই মর্মে ওহী পাঠালেন যে, আপনি চন্দ্রমাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখে‘ রোজা রাখুন। হযরত আদম (আ.) তা-ই করলেন। ফলে তাঁর দেহের রং আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একারণে এই তিনটি আইয়্যামে বীজ বা উজ্জ্বল দিন বলা হয়।
হযরত নূহ (আ.)-এর যুগে‘ রোজা
হাদিস শরীফে হযরত নূহ (আ.)-এর যুগে‘ রোজার প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত রাসুল (সা.) ইশরাদ করেন- “ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ছাড়া হযরত নূহ (আ.) সারা বছর‘ রোজা রাখতেন।” (ইবনে মাজাহ্ ) তাফসীরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ আছে, হযরত নূহ (আ.)-এর যুগে প্রতিমাসে তিনদিন‘ রোজা রাখার হুকুম ছিল। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত বহাল ছিল। শুরুতে মুসলমানগণও মাসে তিন দিন‘ রোজা রাখতেন। মাহে রমজানের একমাস‘ রোজা পালনের হুকুম সম্বলিত আয়াত নাযিল হলে, তা রহিত হয়ে যায়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
হযরত মুসা (আ.)-এর যুগে‘ রোজা
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরত করে মদীনায় আগমণ করার পর দেখলেন যে, ইয়াহুদীরা আশুরার দিন‘ রোজা পালন করছে। তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- এটি কি ধরনের‘ রোজা? জবাবে তারা বলল, এটি আমাদের জন্য একটি পবিত্র দিন। এদিনে আল্লাহ তা’আলা তাঁর দুশমন ফির’আউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে হত্যা করে বনী ইসরাঈলকে নাজাত দিয়েছেন। তাই এ দিনে শুকরিয়াস্বরূপ হযরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন। (বোখারী শরীফ) এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মুসা (আ.)-এর যুগেও‘ রোজা ছিল এবং সে ধারা বনি ইসরাইল ও ইয়াহুদীদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত বজায় ছিল।
হযরত দাউদ (আ.)-এর যুগে‘ রোজা
ইমাম বোখারী (রহঃ) একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) কে নবী করীম (সা.) বললেন-তুমি হযরত দাউদ (আ.)-এর অনুরূপ‘ রোজা রাখ। তিনি [হযরত দাউদ (আ.)] একদিন‘ রোজা রাখতেন এবং একদিন বিরতি দিতেন।” (বোখারী শরীফ)
হযরত ঈসা (আ.)-এর যুগে‘ রোজা
হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের সময় কৌতুহলী জনতা তাঁর মাতা মারইয়ামকে তাঁর জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে থাকলে, উত্তরে তিনি বললেন -আমি দয়াময় আল্লাহর উদ্দেশ্যে মান্নত করে‘ রোজা রেখেছি। সুতরাং আমি কোন কিছুতেই কোন মানুষের সঙ্গে বাক্যলাপ করবো না। (সুরাহ্ মারইয়াম, ২৬)
জাহেলী যুগে কুরাইশ ও মুশরিকদের‘ রোজা
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশূরার দিনে‘ রোজা রাখত। (বোখারী শরীফ) সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রামাযানের একমাস সিয়াম সাধনা নির্দিষ্ট হবার পূর্বে বিশ্বের সকল জাতিই কম-বেশি‘ রোজার সাথে পরিচিত।
ইসলামের‘ রোজা
ইসলামী শরীয়তে রামাযানের‘ রোজা ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরী সনের শা’বান মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এর পূর্বে মুসলমানদের ওপর‘ রোজা ফরজ ছিল কি-না, এব্যাপারে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে, রামাযানের পূর্বে কোন‘ রোজা ফরজ ছিল না। আবার কারো কারো মতে, আশুরার‘ রোজা ফরজ ছিল। আবার কারো কারো মতে, আইয়্যামে বীজের রোজা ফরজ ছিল। পরবর্তীতে রামাযানের বিধান অবতীর্নের পর তা রহিত হয়ে যায়। ইসলামের সেই প্রাথমিক‘ রোজার সময়ে নিয়ম ছিল যে, সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার করার সময় থেকে নিয়ে ঘুমাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্বামী-স্ত্রী সহবাস করা যাবে। কিন্তু রাতে একবার ঘুমিয়ে পড়লে, তার জন্য সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যেত। এতে অনেক সাহাবী (রা.) নানা রকম অসুধিবার সম্মুখীন হন। সাহাবায়ে কেরামের এসব সমস্যার সমাধানকল্পে আল্লাহ তা’আলা আয়াত নাযিল করেন-“তোমাদের জন্য রামাযানের রাতে স্ত্রী সহবাস বৈধ করা হয়েছে- আর খাও এবং পান কর, যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা (সুবেহ সাদিক) তোমাদের নিকট পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।” (সুরাহ্ বাকারা, আয়াত ১৮৭)
আবার শুরু যামানায়‘ রোজা না রেখে ফিদইয়া দেয়ার অনুমতিও ছিল। পরে তা রহিত হয়ে যায়। তবে অতি বৃদ্ধ (যারা‘ রোজা রাখতে অক্ষম) এবং চিররুগ্ন ব্যক্তির জন্য এ বিধান এখনো বহাল আছে। তারা প্রতিটি‘ রোজার জন্য একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে দু’বেলা পেট ভরে তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াবেন অথবা সদকায়ে ফিতর পরিমান খাদ্যদ্রব্য বা টাকা দান করবেন। উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে,‘ রোজার তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনেক।