রাজধানী
ছাত্র-জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা
পুলিশের বুলেটে নিভে যায় হাফেজ আনাস বিল্লাহর জীবন প্রদীপ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন প্রায় শতাধিক মাদরাসা শিক্ষার্থী। যাদের ১৬ জন শিশু। ৭ মাদরাসা শিক্ষকের প্রাণ গেছে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। জীবন উৎসর্গ করেছেন প্রাক্তন ২৩ মাদরাসা শিক্ষার্থী।
Printed Edition
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন প্রায় শতাধিক মাদরাসা শিক্ষার্থী। যাদের ১৬ জন শিশু। ৭ মাদরাসা শিক্ষকের প্রাণ গেছে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। জীবন উৎসর্গ করেছেন প্রাক্তন ২৩ মাদরাসা শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের মধ্যে প্রায় একশত জনের মাদরাসার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২১ জন ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেজ। তবে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ‘তরুণ আলেম প্রজন্ম’ নামের একটি সংগঠন এই তালিকা করেছে। এতে ৭৮ জনের নাম ছিল। দৈনিক সংগ্রাম ও ‘‘৩৬শে জুলাই গণঅভ্যুত্থান’’ গ্রন্থের তথ্য বিশ্লেষণে ৭৮ জনসহ ১৪ জন কুরআনের হাফেজ জুলাই বিপ্লবে শহীদ হওয়ার তথ্য পেয়েছে। তা’মিরুল মিল্লাত মাদরাসার সর্বোচ্চ ৫ শিক্ষার্থী জীবন দিয়েছেন অভ্যুত্থানে। জুলাই বিপ্লবে শহীদ হওয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনজন বাসায় বা পথে গুলিতে নিহত হয়েছেন, বাকিরা জীবন দিয়েছেন সরাসরি আন্দোলনে নেমে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আখতার হোসেন বলেছেন, মাদরাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা জনতার সঙ্গে রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তরুণ আলেম প্রজন্মের মাওলানা বেলাল আহমেদ বলেন, অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। তাদেরই একজন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের মাদরাসা ছাত্র হাফেজ আনাস বিল্লাহ।
শহীদ হাফেজ আনাস বিল্লাহ:৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্ট ২০২৪ স্বৈরাচারী ও গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে বন্ধুদের সাথে আনন্দ মিছিলে যায় সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের মাদরাসা ছাত্র হাফেজ আনাস বিল্লাহ। আর এই আনন্দ মিছিল যে তার কাল হয়ে দাঁড়াবে তা সে স্বপ্নেও বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারেনি যে তার জীবন প্রদীপ এভাবে নিভে যাবে! আনাস বিল্লাহর ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শেষ করে সে বিদেশ গিয়ে ভালো একটি চাকুরি করবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ওই আনন্দ মিছিলে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ও পুলিশের ছোড়া বুলেটে তার সে ইচ্ছা আর পূরণ হলো না। শহীদ হাফেজ আনাস বিল্লাহ (১৭) আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের মো. আব্দুল আরেজ (৫০)-এর মেঝ ছেলে এবং স্থানীয় কাকবাশিয়া মদিনাতুল উলুম ফাজিল মাদরাসার দাখিল পরীক্ষার্থী। তার মায়ের নাম আনেয়ারা খাতুন (৪০)। তিনি একজন গৃহিনী। এই দম্পতির বড় ছেলের নাম আরিফ বিল্লাহ (২৫)। সে প্রতাপনগর এবিএস ফাজিল মাদরাসার ১ম বর্ষের ছাত্র। আর ছোট ছেলের নাম আহসান উল্লাহ। তার বয়স মাত্র সাড়ে ৪ বছর।
আনাস বিল্লাহ সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের অভিব্যক্তি এবং শহীদ হওয়ার বর্ণনা: জুলাই বিপ্লবে শহীদ হাফেজ আনাস বিল্লাহর বড় ভাই আরিফ বিল্লাহ জানান, ৫ আগস্ট ২০২৪ স্বৈরাচারী ও গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে প্রতাপনগরের ছাত্র-জনতা স্থানীয় তালতলা বাজারে একটি আনন্দ মিছিল বের করে। এই মিছিলে আমার ভাইসহ তার বন্ধুরা যোগ দেয়। তিনি বলেন, মিছিলটি ফুলতলা বাজার ও কল্যাণপুর বাজার হয়ে নাকনা গ্রামের স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের বাড়ির সামনে গেলে সেসহ আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী ওই শান্তিপূর্ণ আনন্দ মিছিলকে লক্ষ্য মুহুর্মুুহু গুলী ছোড়ে। এতে আমার ভাই আনাস বিল্লাহসহ কয়েকজন আহত ও নিহত হন। আমার ভাইয়ের শরীরে মোট তিনটা গুলী লাগে।
তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে একটি গুলী তার তলপেটের ভেতরে ঢুকে কিডনিতে লাগে। আরেকটি গুলী তার বুকে ও অপরটি তার ডান হাতে লাগে। এতে তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। একপর্যায়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আমার এই ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর শোক আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমার বৃদ্ধ মা বাবা এখনও তার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে। তিনি বলেন, আমার বাবা একজন দরিদ্র মানুষ। স্থানীয় তালতলা বাজারে আমার বাবার একটি হাড়িপাতিলের দোকান আছে। সেটা চালিয়ে আমাদের পরিবারের সবারই জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আনাস বিল্লাহ’র মা আনোয়ারা খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার মেঝ ছেলে হাফেজ আনাস বিল্লাহ এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে দুনিয়া থেকে চলে যাবে তা আমি কখনও ভাবতে পারিনি। ছেলে আমার দুপুর বেলা বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে দোকানে গেল। আমি তাকে যত্ন করে খাওয়া-দাওয়া করালাম। এরপর সে দোকানে চলে গেল। তারপর কীভাবে কী হয়ে গেল জানি না। আমার ছেলে মারা গেছে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতেই পারছি না। আমি এখনও পথ চেয়ে বসে থাকি আমার ছেলে ফিরে আসবে বলে। তিনি তার ছেলের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার দাবি করেন।
আনাস বিল্লাহ’র বাবা আব্দুল আরেজ আবেগ জড়িত কন্ঠে বলেন, ৫ আগস্ট ২০২৪ দুপুরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বিমানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে এটা আমি দোকানে বসে টিভিতে দেখছি। দেখতে দেখতে আমি একপর্যায়ে দোকানের বাইরে এসেছি। বাইরে এসে দেখি আমার বড় ছেলে ভ্যানের উপর বসে রয়েছে। কিন্তু আমার ছোট ছেলে আনাস বিল্লাহ সেখানে নেই। এরই মধ্যে অনেকেই বলছে দোকানদার আজ ঈদের মতো আনন্দ লাগছে। তুমি আমাদেরকে কিছু খেতে দাও। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে মুড়ি ও চানাচুর এনে খেতে দিলাম। এরই মধ্যে খবর আসলো আমার ছেলেসহ তার বন্ধুরা ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলে গেছে। আর ওই আনন্দ মিছিলে আওয়ামীলীগ নেতা সাবেক চেয়ারম্যান জারিকসহ তার লোকজন গুলীবর্ষণ করছে। একথা শুনে আমি দৌড়াতে দৌড়াতে জাকির চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে যেতে লাগলাম। এরই মধ্যে আমার কাছে অসংখ্য বার ফোন আসছে। কিন্তু ফোনটা আর আমার ধরার কথাও মনে পড়েনি। হঠাৎ আমার এক প্রতিবেশী পথিমধ্যে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে আমাকে বলল আমার ছেলের গায়ে গুলী লাগছে। একথা শুনেই আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না।
আমি তাকে বললাম আমার ছেলের গুলী কোথায় লেগেছে? সে বললো বুকে লেগেছে। তখন আমি বললাম তাহলে আমার ছেলে আর বেঁচে নেই। আমরা যখন ঘটনাস্থলে গেলাম এর আগেই ঘটনাস্থলে থাকা স্থাণীয় লোকজন আমার ছেলেকে নিয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। একপর্যায়ে বামনডাঙ্গায় গিয়ে তাদের সাথে আমার দেখা হলো। সেখানে আমাদের এলাকার গ্রাম্য ডাক্তার খায়রুজ্জামান বলল, আনাস বিল্লাহ মারা গেছে। আর তাকে মেডিকেলে নেয়ার প্রয়োজন নেই। সেখান থেকে তাকে নিয়ে ফিরে এসে বাড়িতে নিয়ে জানাজা নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি। তিনি এসময়, ছেলে হারানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকেন এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে যারা গুলী করে হত্যা করেছে তাদের বিচার মহান আল্লাহ পাকের ওপর ছেড়ে দিলাম।
জামায়াতের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা অনুদান প্রদান: জুলাই বিপ্লবে শহীদ হাফেজ আনাস বিল্লাহ’র বড় ভাই আরিফ বিল্লাহ জানান, আমার ভাই মারা যাওয়ার পর জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ ও ঢাকার নারী ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ৫০ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছি। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ৫ লাখ টাকার একটি অনুদান পেয়েছি।
জুলাই বিপ্লবে শহীদ হওয়া আরও মাদরাসার কয়েকজন ছাত্র: ৯ বছর বয়সী শাফক্বাত সামির ১৯ জুলাই নিহত হয়। এ শিশু মিরপুরে জামেউল উলূম মাদরাসার নূরানী বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। একই দিনে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আল্লাহ করিম মসজিদের সামনে র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলীতে নিহত হয় ১২ বছর বয়সী জোবাইদ হোসাইন ইমন। ১৩ বছর বয়সী রাব্বি মাতবর ১৯ জুলাই মিরপুরে নিহত হয় গুলীতে। ১৪ বছর বয়সী ইবরাহীম খলিল যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকার হাফেজি মাদরাসার শিক্ষার্থী ছিল। সমবয়সী সাদ মাহমুদ খান ছিল মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের জাবালে নূর দাখিল মাদরাসার ছাত্র। ২০ জুলাই সাভারের নিউমার্কেটের সামনে গুলীতে নিহত হয় সে। কিশোর আশিকুল ইসলাম আল-ইয়াস আশিক ১৯ জুলাই বনশ্রীতে গুলীতে নিহত হয়। তামিরুল মিল্লাত মাদরাসার ১৫ বছর বয়সী ছাত্র মুহাম্মাদ আদিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে ২০ জুলাই নিহত হয়। চোখে গুলীবিদ্ধ ১৬ বছর বয়সী মো. বাঁধন ৬ আগস্ট মারা যান। সমবয়সী আশিকুল ইসলাম ১৯ জুলাই দিনাজপুরে গুলীতে নিহত হয়। শরীয়তপুরের মাদরাসারশিক্ষার্থী এবং হাফেজ সিফাত হোসাইন পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের ইংলিশ রোডে গুলীতে নিহত হন।
১৭ বছর বয়সী শহীদ নাহিদুল ইসলাম ৫ আগস্ট আদাবর থানার সামনে নিহত হয়। একই দিনে নিহত হন খিলগাঁওয়ের আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলূমের ছাত্র হাফেজ মুহাম্মাদ যুবায়ের আহমাদ। ৫ আগস্ট চাঁনখারপুলে গুলীবিদ্ধ ১৭ বছর বয়সী ইশমামুল হক দুই দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান।
তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার ১৭ বছর বয়সী ছাত্র সায়েদ মুনতাসীর রহমান ৫ আগস্ট নিহত হন। ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরে প্রাণ হারান চাঁদপুরের ফুলছোঁয়া মাদরাসার ১৮ বছর বয়সী হাফেজ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বির। গাজীপুরের মাখলাজুন ঈমান মাদরাসার শিক্ষার্থী মো. আয়াতুল্লাহর মরদেহ ১৬ আগস্ট ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাওয়া যায়। ৪ আগস্ট গুলীবিদ্ধ হন জামিয়া আশরাফিয়া মাদরাসার আব্দুল্লাহ আল মামুন।
মাদারীপুরে হাফেজ সাদিকুর রহমান ও তাওহীদ সান্নামাত ১৯ জুলাই নিহত হন। তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার আলিম শিক্ষার্থী নাসির ইসলাম ২০ জুলাই ঢাকায় এবং দেবীদ্বার ছৈয়দপুর কামিল মাদরাসার মুহাম্মাদ জহিরুল ইসলাম রাসেল ৪ আগস্ট কুমিল্লায় নিহত হন। মাদরাসাতুল আবরারের শিক্ষার্থী হাফেজ আবদুল্লাহ শনির আখড়ায়, হাফেজ আনাস বিল্লাহ ও আরজ আলী সাতক্ষীরায় নিহত হন ৫ আগস্ট। সাব্বির ১৮ জুলাই গুলীতে নিহত হন। বারিধারার জামিয়া মাদানিয়ার হাফেজ মাহমুদুল হাসান, খালিদ সাইফুল্লাহ, জামিয়া বাগে জান্নাত মাদরাসার মাবরুর হুসাইন (গোলাম রাব্বি) ও শাহজাহান হৃদয় মহাখালীতে ২৪ জুলাই নিহত হন। ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে মো. শাকিল, দারুস সালাম মাদরাসার নুর মুস্তফা কক্সবাজারের ঈদগাঁওয়ে, জামিয়া কারিমিয়া আলেয়া বেগম বহুমুখী মাদরাসার জয়নুল আবেদীন ও কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল উলূমের মুহাম্মাদ সিফাতুল্লাহ নিহত হন। ২১ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে গুলীবিদ্ধ মাইন উদ্দিন ২৫ জুলাই নিহত হন। ২০ জুলাই নরসিংদীর মাধবদীতে গুলীবিদ্ধ সুমন মিয়া ২৩ আগস্ট মারা যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হোসাইন মিয়া ৪ আগস্ট নিহত হন। একই দিনে ফেনীতে গুলীবিদ্ধ মাহবুবুল হাসান মাসুম ৭ আগস্ট চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।