রাজধানী
রহমত মাগফিরাত নাজাতের মাস রমযান
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কলুষময় আত্মা ও ক্লেদাক্ত জীবনধারা থেকে বেরিয়ে আসার অপার সুযোগ মাহে রমযানুল মোবারক। যে ব্যক্তি এ মাসে সময়কে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যবহার করবে সে ব্যক্তিই নাজাত পাবে। অর্জন করতে পারবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, হতে পারবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা। রহমতের দশক শেষ পর্যায়ে। আজ রমযানের ৭ম দিন।
Printed Edition

মিয়া হোসেন : সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কলুষময় আত্মা ও ক্লেদাক্ত জীবনধারা থেকে বেরিয়ে আসার অপার সুযোগ মাহে রমযানুল মোবারক। যে ব্যক্তি এ মাসে সময়কে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যবহার করবে সে ব্যক্তিই নাজাত পাবে। অর্জন করতে পারবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, হতে পারবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা। রহমতের দশক শেষ পর্যায়ে। আজ রমযানের ৭ম দিন।
রমযানের অন্যতম কাজ হলো রোযা পালন করা। রোযা মুমিনের জন্য এক অফুরন্ত নেয়ামতস্বরূপ। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে মুমিন ক্ষুধা, পিপাসা, কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে রোজা পালনে ব্রতী হন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমযানের রোজা পালন করতে গিয়ে রোজার সীমারেখা বুঝে নেবে এবং যে কর্তব্য রোজার ভেতর পালন করা বাঞ্ছনীয়, তা যথার্থভাবে পালন করে চলবে, তার এরূপ রোজা তার বিগত গুনাহের ক্ষমার কাফফারা হয়ে যাবে। (বায়হাকি : ১১৩৪)।
কুরআন কারীমে আল্লাহ স্পষ্ট বলেছেন- রোজার মূল উদ্দেশ্য হল তাক্বওয়া হাসিল করা। রোজা পালন করলেই তাকওয়া বা মুত্তাকী হওয়া যায় না। মুত্তাকী হওয়ার জন্য মুত্তাকীর গুণাবলী অর্জন করতে হয়। রোজার অনেক বড় ফজিলত হলো ‘তাকওয়াবান হওয়া’। রোজা রাখলে তাকওয়া অর্জন হয়। কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা এ মর্মে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে, মুমিন মুসলমানের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেন তারা তাকওয়া অর্জন করতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের আগের লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি বা তাকওয়াবান হতে পারো।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
হজরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাকওয়া কী? হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আপনি কি কখনো কাঁটা বিছানো পথে হেঁটেছেন? উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হ্যাঁ’। হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু জানতে চাইলেন, (কাঁটা বিছানো পথে) আপনি কীভাবে হেঁটেছেন? উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘খুব সাবধানে, কষ্ট সহ্য করে হেঁটেছি; যাতে আমার শরীরে কাঁটা বিঁধে না যায়। (তখন) হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এটাই হচ্ছে তাকওয়া।’ (তাফসিরে কুরতুবি, ইবনে কাসির)
হাদিসের এই উদাহরণ থেকে প্রমাণিত, কাঁটাযুক্ত পথে কাঁটা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ যেভাবে সতর্ক হয়ে চলে, ঠিক সেভাবে আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন তা মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে যা নিষিদ্ধ করেছেন সেগুলো থেকেও বেঁচে থাকা। আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়ার জন্য আল্লাহ যা ভালোবাসেন, সেই অনুযায়ী আমল করা। এর নামই ‘তাকওয়া’।
মূলত এ ‘তাকওয়া’ অন্তরের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা কাউকে দেখানো যায় না। সহজ বাংলায় যাকে বলা হয় ‘আল্লাহভীতি’। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে রমযানজুড়ে আল্লাহর ভয় অর্জনে রোজা রাখার বিধান দিয়েছেন। এতে মুমিন মুসলমানের জন্য রয়েছে তাকওয়া অর্জনের মহাসুযোগ। কুরআন নাজিলের এ মাসে রোজা রেখে তাকওয়া অর্জন করতে পারলে মহান আল্লাহ দান করবেন মহামূল্যবান নেয়ামত- হেদায়েত তথা সঠিক পথ। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘রমযান মাস এতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হেদায়তের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোজা পালন করে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ কর এবং তিনি তোমাদের যে হেদায়াত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
যেসব শর্তের আলোকে মানুষের ওপর রোজা রাখা ফরজ, তা পাওয়া গেলে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। এমনটিই মুমিন মুসলমানের প্রতি মহান আল্লাহর নির্দেশ। আর এ নির্দেশ ছিল উম্মতে মুহাম্মাদির আগের লোকদের জন্যও। যারা আল্লাহর বিধান পালন করতে গিয়ে রোজা রাখবে, তারাই হবে তাকওয়াবান বা আল্লাহকে ভয়কারী। এছাড়াও কুরআন-হাদিসে রোজা পালনের অনেক উপকারিতা ঘোষণা করা হয়েছে।
সুতরাং রমযানের নির্দেশনা হলো দিনের বেলায় হালাল বস্তু খাওয়া ও পান করা, বৈধ স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা থেকে বিরত থাকার মাধ্যম রোজা পালন করা। কেউ যদি আল্লাহর শাস্তির ভয়ে দিনের বেলা উল্লেখিত হালাল কাজগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে তাহলে নিঃসন্দেহে সে আল্লাহর ভয় অর্জন করতে পারবে।
পাশাপাশি যারা আল্লাহর নির্দেশে হালাল কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারে, নিঃসন্দেহে তারা দুনিয়ার সব হারাম কাজ থেকেও বিরত থাকতে পারবে। আর আল্লাহর ভয়ের মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়।
রোজা মানুষকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে হেফাজত করে, যৌন উত্তেজনাকে প্রশমিত করে। রোজা রাখার ফলে মানুষের যখন ক্ষুধা লাগে তখন মানুষ গরিব-দুঃখির না খাওয়ার কষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়। তাদের প্রতি রোজাদারের হৃদয় ও মন আকৃষ্ট হয়। তাদের ক্ষুধার কষ্ট লাগবে রোজাদারের দান-খয়রাত করার মানসিকতা তৈরি হয়।
কষ্টের সম্মুখীন হওয়া ছাড়া মুখে শুনে কিংবা বই পড়ে কোনো মানুষই কষ্টের পরিপূর্ণ বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারে না। যখন মানুষ কষ্টের সম্মুখীন হয় তখনই কেবল বাস্তব কষ্ট কেমন তা বুঝতে সক্ষম হয়। যেমনিভাবে গাড়িতে চড়া ব্যক্তি পায়ে হাঁটা ব্যক্তির কষ্ট কখনো অনুধাবন করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে সমান দূরত্ব পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি না দেয়।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যারা হিদায়াতকে বর্জন করার ক্ষেত্রে আল্লাহর শক্তিকে ভয় করেন এবং তার নির্দেশকে সত্য প্রতিপন্ন করার কারণে রহমতের আশা ছাড়েন না তারাই মুত্তাকী।
মাসব্যাপী রোজা পালন করে যদি তাকওয়া অর্জন করা না যায় তাহলে এ রোজা অর্থহীন উপবাস ও নিছক আত্মপ্রবঞ্চনায় পর্যবসিত হয়। (মুসলিম: ২১৩৪)।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি বাজে কথা ও কাজ ত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগ নিছক উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়’। (বুখারি : ১৮০৪)।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে আরও এরশাদ করেন- শুধু পানাহার বর্জনের নাম রোজা নয়। রোজা হল অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করার নাম। কেউ তোমাকে গালি দিলে বা তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে তুমি তার সঙ্গে তেমনটি না করে কেবল এটুকুই বল আমি রোজাদার’। (মুসলিম : ২৪১৬)।
হজরত রাসূলে কারীম এরশাদ করেন- অনেক রোজাদার এমন, যারা রোজা রেখে কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই পায় না; আর যারা রাত জেগে নামায আদায় করে তাদের মধ্যেও এমন বহু লোক আছে, নামাযে দাঁড়িয়ে রাত জেগে কষ্ট করা ছাড়া যাদের আর কোনো লাভ হয় না। (ইবনু মাজাহ : ১৬৯০)।
রমযান মাসের রোজা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করতে পারলেই মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে জীবনের জানা-অজানা গোনাহের ক্ষমা লাভ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে।