প্রবীন রাজনীতিক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। দলের সিনিয়ল যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে তিনি মারা গেছেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী জানান, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জানাযা শেষে মরহুমের লাশ চট্টগ্রামে নেওয়া হয়েছে। সেখানে আগামী শুক্রবার বাদ জুমা শেষ জানাযা শেষে দাফন হবে।

পরিবারের সদস্যরা জানান, ভোরে ধানমন্ডির ৮ নম্বর সড়কে অসুস্থ হয়ে পড়েন আবদুল্লাহ আল নোমান। দ্রুত তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। দীর্ঘদিন ধরে আবদুল্লাহ আল নোমান বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৩ বছর। তিনি সহধর্মিনী, এক ছেলে এক মেয়ে রেখে গেছেন।

আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। ধানমন্ডির বাসায় নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ নেতারা বাসায় আসেন

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের দ্বিতীয় জানাযা নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সংসদ ভবনে বিএনপির এই নেতার প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে দলীয় পতাকা ও ফুলের শ্রদ্ধা জানানো হয়।

জানাযার আগে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা মরহুম আবদুল্লাহ আল নোমানের বিশাল বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে স্মৃতি চারণ করেন। তার মতো অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতার চলে যাওয়ার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি হবে বলেও মনে করেন তারা।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমানের চলে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করবে। তার মতো ত্যাগী ও প্রগতিশীল মানুষের যখন সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন তার চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। তার শূন্যতা সৃষ্টি হবে।

জানাযায় অংশ নেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপি নেতা শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, আব্দুস সালাম, হাবিব উন নবী খান সোহেল, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বিএলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম প্রমুখ।

বাম ঘরানার রাজনীতি থেকে আসা আবদুল্লাহ আল নোমান ৯০ দশকে বিএনপিতে যোগ দেন। প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা তার রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন শ্রমজীবীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রামে। বিএনপির রাজনীতিতে পথ চলায় তিনি চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি এবং বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব হন। এরপর আমৃত্য তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন সক্রিয়।

১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম- ৯ আসন এবং ২০০১ সালে চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি বেগম খালেদা জিয়ার দুই সরকারের আমলে মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে মৎস্য ও পশু সম্পদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, বন ও পরিবেশ এবং খাদ্য মন্ত্রণায়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সালে তিনি চার দলীয় জোট সরকারের খাদ্য মন্ত্রী ছিলেন। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন আবদুল্লাহ আল নোমান।

ছাত্র জীবনেও আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন রাজনীতিতে সক্রিয়। ষাটের দশকের শুরুতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নোমান যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। মেননপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

আবদুল্লাহ আল নোমানের বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। ছাত্রজীবন শেষে তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। গোপনে ভাসানীপন্থি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত হন। ১৯৭০ সালে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হন তিনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আবদুল্লাহ আল নোমান সরাসারি যুক্ত ছিলেন। যুদ্ধ শেষে ন্যাপের রাজনীতিতে তার পথ চলা। এরপর ১৯৮১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক জিয়্উার রহমানের প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে যোগ দেন আবদুল্লাহ আল নোমান।

আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পাঠানো এক শোকবার্তায় তা জানানো হয়। শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন গুণী নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ষাটের দশকের শুরু থেকে জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি তার রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

নোমানের মৃত্যুতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পৃথক পৃথকভাবে শোক প্রকাশ করে তার রুহের মাগফেরাত এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও পদত্যাগের আগে এই প্রবীন নেতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন।

আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন এলডিপি প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। শোক প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াত। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বিবৃতিতে মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী ও সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন উল্লেখ করেন, আবদুল্লাহ আল নোমান একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। তার মৃত্যুতে বিএনপির রাজনীতিতে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন আবদুল্লাহ আল নোমানকে বেহেশত নসিব করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সবাইকে ধৈর্যধারণের তৌফিক দান করার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। শোকবার্তায় তিনি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।