দুর্বার অসহযোগ আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস মার্চের অষ্টম দিন আজ শনিবার। ঊনিশশ’ একাত্তর সালের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। গোটা ঢাকা শহর কালো পতাকার শহরে পরিণত হয়। ইতোমধ্যে বিদেশীদের ক্রমে ঢাকা ত্যাগ করতে দেখা যায়। এদিন রাজপথে মিছিলকারীরা বাঁশের লাঠি নিয়ে আসে। এত বিদ্রোহ কেউ কখনো দেখেনি। এমন গতিশীল আর বেগবান আন্দোলন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর কখনো ঘটেনি।
এদিন বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলীবর্ষণ সম্পর্কে সামরিক সরকার একটি প্রেসনোট প্রকাশ করে। প্রেসনোটে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর গুলীতে হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে বলে যা প্রকাশ করা হচ্ছে তা ‘মিথ্যাচার’ অভিহিত করে স্বীকার করা হয়, গত সাত দিনে ১৭২ জন নিহত ও ৫৮ জন আহত হয়েছে। এদিন বেশ ক’জন বৃটিশ ও ১৭৮ জন জার্মান নাগরিক ঢাকা ত্যাগ করেন। এদিন রাতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে হরতাল-মিছিল করতে এক নির্দেশনামা জারি করেন। এতে বলা হয়, সকল ব্যাংক ব্যাংকিং কাজের জন্য সকাল ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এবং বেলা ৩টা পর্যন্ত প্রশাসনিক কাজের জন্য খোলা থাকবে।
২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ৮ মার্চ থেকে এক সপ্তাহের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, ১. খাজনা-ট্যাক্স বন্ধে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ২. সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে এ ব্যাপারে কোনো কোনো অংশকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হবে। ৩. রেলওয়ে ও বন্দরগুলো চালু থাকতে পারে। কিন্তু যদি জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে সৈন্য সমাবেশের জন্য রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহার করা হয়। তাহলে রেলওয়ে শ্রমিক ও বন্দর শ্রমিকরা সহযোগিতা করবে না। ৪. বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আমাদের বিবৃতিসমূহের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে এবং তারা জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে খবর গোপন করতে পারবে না। অন্যথায় এ সকল প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে বাঙালিরা সহযোগিতা করবে না। ৫. কেবল স্থানীয় ও আন্তঃজেলা ট্রাংক, টেলিফোন যোগাযোগ চালু থাকবে। ৬. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ৭. ব্যাংকগুলো স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো উপায়ে দেশের পশ্চিম অংশে অর্থ পাচার করতে পারবে না। ৮. প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করতে হবে। ৯. অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থা বিশেষে কোনো সময় উপরোক্ত পূর্ণাঙ্গ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষণা করা হতে পারে। ১০. প্রতি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটি করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। যদিও উপরোক্ত কর্মসূচি এক সপ্তাহের জন্য গ্রহণ করা হয়েছিল, তবু পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, অবস্থার ক্রমাবনতিতে এই কর্মসূচি পুনরাদেশ ছাড়াই বাঙালিরা ১৫ মার্চ পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পালন করেছিল।
ওই গ্রন্থে ৮ মার্চের ঘটনা তুলে ধরে আরো বলা হয়, “বৃটেনে বসবাসরত দশ হাজার বাঙালি স্বাধীন বাংলার দাবিতে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, সেদিন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করেন।