স্টাফ রিপোর্টার : এবার বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিশাল গোপন সম্পদের খবর প্রকাশ করেছে বৃটিশ গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। সেখানে ১৯৯২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর নানা প্রান্তে সাইফুজ্জামান এবং তার পরিবার কীভাবে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। খবরের শিরোনাম দেয়া হয়েছে- ‘দ্য বাংলাদেশি পলিটিশিয়ান হু বিল্ট আ শ্যাডো গ্লোবাল প্রোপার্টি এম্পায়ার’। এতে বলা হয়েছে, ফ্লোরিডার ওকালা ন্যাশনাল বনের পশ্চিম সীমান্ত। অরল্যান্ডো থেকে উত্তরে মাত্র এক ঘণ্টার গাড়ি চালানোর রাস্তা। সেখানে এক খণ্ড আধা একর জমি রয়েছে যা শিগগিরই আন্তর্জাতিক মামলার বিষয়বস্তু হতে পারে। জমিটি এখনো অব্যবহৃত। এটি পুনরুদ্ধার করেছে বনবিভাগ। তবে জমিটির মালিকানার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মামলার বিষয়বস্তু হতে পারে। ম্যারিয়ন কাউন্টির সম্পদ মূল্যায়নকারীর রেকর্ড থেকে জানা যায়, ওই জমিটি প্রায় দুই দশক আগে ক্রয় করেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
শেখ হাসিনার সরকারের সংসদ সদস্য থাকাকালীন সাইফুজ্জামান ৪৮ হাজার ডলারের যে রিয়েল এস্টেট সম্পদ ক্রয় করেছিলেন তার একটি হচ্ছে ফ্লোরিডার ওই জমি। ১৯৯২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৯৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৪৮২টি সম্পদের খোঁজ পেয়েছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। তার অর্জিত এসব সম্পদের একটি অংশ ফেরত চায় বাংলাদেশ। কেননা, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িতদের সন্দেহের মধ্যে সাইফুজ্জামানও একজন। আরব আমিরাতের জমকালো শহর দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা এবং পাম জুমেইরা নামক কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে লন্ডনের কমিউটার শহরগুলোতে রয়েছে সাইফুজ্জামানের বিশাল সম্পদের পাহাড়। সেখানে রয়েছে দামি দামি অ্যাপার্টমেন্ট। যেগুলো সব নবনির্মিত এবং দুই শয়নকক্ষবিশিষ্ট। ভূমিমন্ত্রী হওয়ার আগে পাঁচ বছর সংসদ সদস্য ছিলেন সাইফুজ্জামান। ২০২৩ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন তার মোট সম্পদের পরিমাণ মাত্র ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালে আয়করের নথিতে তিনি উল্লেখ করেন দেশের বাইরে তার কোনো সম্পদ নেই। শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অন্যান্য এলিটদের সঙ্গে তিনি এবং তার কিছু আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে।
দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তার অনুমান শেখ হাসিনার আমলে দেশ থেকে কমপক্ষে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, পাচারকৃত ওই টাকা জনগণের। যা তারা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে প্রকাশ্য দিবালকে কেড়ে নিয়েছে। সাইফুজ্জামান হলেন দেশের পুরনো ধারার একজন ধনকুবের- যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের নজরদারিতে আছেন। আহসান এইচ মনসুর বলেন, তিনি এর আগে ভূমিমন্ত্রী ছিলেন এবং মনে হচ্ছে তিনি ভূমি ভালোবাসেন। ফাঁস হওয়া নথি এবং সরকারি বিভিন্ন সূত্রের বরাতে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানতে পেরেছে, সাইফুজ্জামান এবং তার পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরাই ওই সকল সম্পত্তির মালিক। যার মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩১৫টি, দুবাইতে ১৪২টি, নিউইয়র্কে ১৬টি, ফ্লোরিডায় ছয়টি এবং নিউ জার্সিতে তিনটি সম্পদ রয়েছে। গণমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, সিঙ্গাপুর এবং কানাডাতেও বাংলাদেশী এলিটদের দ্বারা অধিগ্রহণ করা প্রায় ৫৭৮ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশ থেকে এলিট শ্রেণির এভাবে অর্থ পাচারকে ‘হাইওয়ে ডাকাতি’ বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
সাইফুজ্জামানের বাবার নাম আখতারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। পাশাপাশি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনও ছিলেন। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। ইউসিবি’র সঙ্গে জড়িত দুটি সহিংস ঘটনার জন্য বেশ কুখ্যাত হয়ে ওঠেন সাইফুজ্জামানের বাবা। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল ১৯৯৩ সালের ৮ই এপ্রিলের একটি ঘটনা। যখন ঢাকায় ইউসিবি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুমায়ুন জহিরকে নিজ বাড়ির বাইরে গুলী করে হত্যা করা হয়। ব্যাংকের পরিচালকদের মতবিরোধের মধ্যে আখতারুজ্জামানকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় আসার পর দেশে আসেন আখতারুজ্জামান। তিনি জামিনে থাকলেও সেসময় ওই আইনি প্রক্রিয়া পুরো থমকে যায়। পরের ঘটনাটি ১৯৯৯ সালের। তখন বন্দুকের মুখে জিম্মি করে ইউসিবি ব্যাংক দখলের চেষ্টা করেন আখতারুজ্জামান। ফলে তাকে বোর্ড থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ওই ঘটনার দুই বছর পর ক্ষমতা হারান হাসিনা। তবে তিনি ২০০৯ সালে ফিরে আসলে পুনরায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেন আখতারুজ্জামান। ২০১২ সালে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর সাইফুজ্জামানের পুরো পরিবার ইউসিবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বলবৎ থাকেন। হাসিনার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠনের ঘোষণা দেয়ার আগ পর্যন্ত ইউসিবিতে পুরো আধিপত্য ধরে রাখেন সাইফুজ্জামান ও তার পরিবার।
গত ডিসেম্বরে ইউনূস সরকার গঠিত অর্থনৈতিক কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে অর্থ পাচারের কারণে বার্ষিকভাবে বাংলাদেশ ১৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বৃহৎ সরকারি প্রকল্পের ব্যয়, কর ছাড় এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ করে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কমিশন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপুল ওই সম্পদের সাম্রাজ্য উদ্ধারের আশায় তদন্তকারীদের ভৌগোলিকভাবে বেশ জটিলতায় পড়তে হবে। অপরাধীরা কী পরিমাণ সম্পদ ক্রয় করেছে তা গোপন করার প্রচেষ্টার সঙ্গে লড়াই করতে হবে তাদের। তবে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস নিশ্চিত হয়েছে যে, সাইফুজ্জামান যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন সেগুলো স্পষ্টতই তার সঙ্গে সম্পর্কিত। কেননা, নথিপত্রে সরাসরি তার নাম রয়েছে।
২০১৯ সালে ভূমিমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর চৌধুরীর বাড়ি কেনার আকস্মিক বৃদ্ধির পেছনে একটি ঋণদাতা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কোম্পানিজ হাউসের নথি অনুসারে, বৃটিশ বন্ধকগুলোর সিংহভাগই এসেছে মার্কেট ফিন্যান্সিয়াল সলিউশনস নামে একটি ঋণদাতা সংস্থার মাধ্যমে, যার মালিক বৃটিশ ব্যবসায়ী পরেশ রাজা। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে চৌধুরীর কোম্পানিকে ঋণ দেয়া শুরু করে ওই সকল সংস্থা। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ৪৯৫টি অভিযোগের মধ্যে ২৯১টির সঙ্গে ওই সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টতা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর অনেক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে চৌধুরী এবং তার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে ৩৫২টি বন্ধকের মধ্যে ২৫৯টি পরিশোধ করে। যার মধ্যে মার্কেট ফিন্যান্সিয়াল সলিউশনসের একটি বন্ধকও রয়েছে।
বৃটেনের ব্যবসায়ীদের কাছে সবচেয়ে বড় ঋণদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সাইফুজ্জামান। এ ছাড়া ১২টি সম্পদের হিসাব পুনরুদ্ধারের জন্য সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংকে নথিপত্র দাখিল করেছেন তিনি। পরেশ রাজা এবং ডিবিএসের কাছে বৃটেনে চৌধুরীর অর্থ পাচার সম্পর্কে জানতে চায় ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। কেননা চৌধুরী তার নথিপত্রে সম্পদের পরিমাণ মাত্র ২.৩ মিলিয়ন ডলার উল্লেখ করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে ডিবিএস কোনো মন্তব্য করেনি। পরেশ রাজার আইনজীবী বলেছেন, মার্কেট ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনসের একটি বৃহৎ আন্ডাররাইটিং টিম রয়েছে যারা প্রতিটি ঋণ যাচাই-বাছাই করে।
জানা যায়, সিঙ্গাপুরে এস আলমের স্থায়ী বাসস্থানের মূল্য ২ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। যেখানে তিনি হোটেলসহ বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট ক্রয় করেছেন। যার মূল্য আনুমানিক ৪৬৯ মিলিয়ন ডলার। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আলম এবং তার পরিবারের আইনজীবীরা। তারা এসব অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন। আওয়ামী লীগ এবং দেশের শক্তিশালী পোশাক-রপ্তানি শিল্পের অন্যান্য মালিকরাও বিদেশে সম্পদ অর্জন করেছেন বলে খবর রয়েছে। যেমন, কানাডার টরন্টো ধনী বাংলাদেশীদের কাছে এতটাই জনপ্রিয় যে, এটি বেগম পাড়ার একটি প্রধান উদাহরণ হয়ে উঠেছে। যার অর্থ ‘স্ত্রীদের উপনিবেশ’। এমন মানুষদের বোঝাতে এই বেগম পাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাদের পরিবারের সদস্যরা বিদেশের ধনী এলাকায় আরামে বসবাস করছেন। অন্টারিও ল্যান্ড রেজিস্ট্রি নথি ঘেঁটে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে যে, চিহ্নিত ১২টি সম্পদের মধ্যে সাবেক এক আওয়ামী এমপি’র স্ত্রীর নামে ১০ লাখ ডলারের একটি বাড়ি রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১৩ লাখ ডলার।