স্টাফ রিপোর্টার : সিন্ডিকেটের কবলে দেশের পোলট্রিখাত। ঈদ সামনে রেখে অতিরিক্ত দামে মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে পোলট্রি খাতের একটি সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক খামারির। পোলট্রিখাত সংশ্লিষ্টরাই এমন অভিযোগ তুলেছেন। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) বলছে, এখাতের সিন্ডিকেট প্রতিদিন ৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে । সংগঠনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বৃহস্পতিবার জানান পোলট্রিশিল্প দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্য সরবরাহকারী খাত। কিন্তু বর্তমানে এটি একটি করপোরেট সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে; যা দেশের খামারিদের জন্য এক ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সিন্ডিকেটের লক্ষ্য, পোলট্রি বাজারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের ব্যবসা ও মুনাফা কমে যাচ্ছে এবং তাঁরা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন।
সভাপতি সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেন, এই করপোরেট সিন্ডিকেটের প্রধান হলো ব্রিডার কোম্পানি ও ফিড ইন্ডাস্ট্রি। ব্রিডার কোম্পানিগুলো কৃত্রিমভাবে মুরগির বাচ্চার দাম বাড়াচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) ব্রয়লার বাচ্চার জন্য ৪৯ টাকা নির্ধারণ করলেও কোম্পানিগুলো ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি করছে। অন্যদিকে লেয়ার বাচ্চা ৫৭ টাকা নির্ধারিত হলেও ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা খামারিদের জন্য ব্যয়বহুল। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং খামারিরা লাভ করতে পারছেন না। এ ছাড়া চাহিদা বাড়ানোর অজুহাতে এই সিন্ডিকেট ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহ কমিয়ে দেয়, যাতে দাম আরও বাড়ানো যায়। এই কৌশলের মাধ্যমে প্রতিদিন তারা মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে প্রায় ৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
খাত সংশ্লিল্টরা বলছেন , ঈদ ও অন্য বড় উৎসবগুলো সামনে রেখে এই সিন্ডিকেট মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেয়; যা খামারিদের জন্য চাপ হয়ে যায়। যেকোনো বড় উৎসবের সময় খামারিরা বেশি লাভের আশা করেন, কিন্তু সিন্ডিকেট নিজেদের বাড়তি মুনাফার জন্য দাম বাড়িয়ে খামারিদের পকেটে হাত দেয়। তাদের অভিযোগ, ফিড ইন্ডাস্ট্রির সিন্ডিকেট খামারিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বিশ্ববাজারে ফিডের দাম কমলেও দেশে কমছে না। ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাতে ফিডের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যায়, ফলে খামারিরা অতিরিক্ত খরচ বহন করতে বাধ্য হচ্ছেন। সে সময় প্রতি বস্তা ফিডের দাম ২ হাজার ৫০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়। যেহেতু ডিম বা মুরগি উৎপাদনে ৭০-৭৫ শতাংশ খরচ ফিডে চলে যায়, ফিডের দাম বাড়ার ফলে খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
এছাড়া গত আড়াই মাসে মুরগির বাচ্চায় ৭২০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। সূত্র বলছে, বাংলাদেশের পোলট্রি খাতে গত আড়াই মাসে একটি গুরুতর সংকট সৃষ্টি হয়েছে; যা খামারিদের জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বিশেষ করে মুরগির বাচ্চার দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, সিন্ডিকেটের প্রভাব এবং ফিডের দাম বেড়ে যাওয়া খামারিদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে , মুরগির বাচ্চা, পোলট্রি ফিড ও পশুখাদ্য উৎপাদনের শীর্ষ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ হয়। বিশেষ করে নাহার এগ্রো পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, কাজী ফার্মস পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, সিপি বাংলাদেশ, নারিশ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, পিপলস পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, ডায়মন্ড পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারিসহ হাতেগোনা ৮ থেকে ১০টি করপোরেট কোম্পানি বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্বাভাবিক বাজারদর ৩০-৩৫ টাকা থাকলেও ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিটি মুরগির বাচ্চার দাম বেড়ে ৬০-১০০ টাকায় পৌঁছায়; যা ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ৮০ দিন চলমান ছিল।
সূত্র জানায় , প্রতিদিন সব ধরনের মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয় ৩০ লাখ। সে হিসাবে কোম্পানিগুলো প্রতি মুরগির বাচ্চায় গড়ে ৩০ টাকা বেশি নিলে দিনে ৯ কোটি টাকা দাঁড়ায়। এভাবে গত আড়াই মাসে (৮০ দিনে) ৭২০ কোটি টাকা লুটপাট হয়। পোলট্রি ফিড এবং বাচ্চা উৎপাদনকারী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। তারা মিনিটে দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করেছে। এসব অসাধু কার্যক্রম প্রান্তিক খামারিদের ওপর গুরুতর চাপ তৈরি করেছে। অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বাচ্চা ও ফিডের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রান্তিক খামারিরা তাদের পুঁজি হারাচ্ছেন। লাভজনক না হওয়ায় অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে শিক্ষিত নারী, বেকার যুবক উদ্যোক্তাদের প্রায় ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হুমকিতে পড়েছে। মুরগি ও ডিমের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন , কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ ও লাভের পরিমাণ খতিয়ে দেখতে হবে। তারা নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে কি না এবং ভ্যাট দিচ্ছে কি না। সকল কোম্পানি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের জিম্মি করে ফিড ও মুরগির বাচ্চায় অধিক মুনাফা করে। এতে প্রান্তিক খামারির লাভ কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে মুরগির বাচ্চার দাম বর্তমানে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, যা ইতিবাচক। এ পোলট্রি ফিডের দাম কমানো হলে ডিম-মুরগির উৎপাদন খরচ আরও কমানো সম্ভব। সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা উচিত এবং সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। পোলট্রি ফিডের ওপর আরোপিত ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর মাধ্যমে ফিডের দাম কমানো উচিত। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমে যাবে এবং ডিম ও মুরগির দাম সাশ্রয়ী হবে।