DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

রাজধানী

৮ বছরে দুই লাখ অগ্নিকান্ড তিন হাজারের বেশি নিহত

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে রাজধানীসহ সারা দেশে। এতে মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কয়েকগুণ বেড়েছে।

নাছির উদ্দিন শোয়েব
Printed Edition
FRIAR

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে রাজধানীসহ সারা দেশে। এতে মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কয়েকগুণ বেড়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর শাহজাদপুরে একটি আবাসিক হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে চার জন নিহত হয়। এর মধ্যে মিরন জমাদ্দার (৫৫) নামে একজনের মৃত্যুর খবর ছিল বেশি হৃদয় বিদারক। তিনি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন সৌদী প্রবাসী ছেলেকে বিদায় দিতে। বিশ্রামের জন্য উঠেছিলেন ওই আবাসিক হোটেলটিতে। আর সেখানেই অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। মিরনের বাড়ি পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার দারুলহুদা বটতলা গ্রামে। ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে নিজেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, নিরাপত্তা বিধিমালার দুর্বল প্রয়োগে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত আট বছরে সারা দেশে ২ লাখ ৩৬৮টি অগ্নিকান্ড ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ৩ হাজার ২৪ জন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৪ সালে দেশে ২৬ হাজার ৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। নিহত হয়েছে ১৪০ জন। আগের বছর ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয় ১০২ জন এবং আহত হয়েছে ২৮১ জন। ফায়ার সার্ভিসের হিসেব অনুযায়ী আগের বছরের চেয়ে গত বছর অগ্নিকান্ডের ঘটনা ৯৬৫টি কমেছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৩৮টি।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সারা দেশে ২০২৪ সালে দিনে গড়ে ৭৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাস সংক্রান্ত কারণে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। অগ্নিকাণ্ডে সারা দেশে ৩৪১ জন আহত ও ১৪০ জন নিহত হন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেল থেকে আজ মঙ্গলবার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সারা দেশে ২০২৪ সালে অগ্নিকাণ্ডে ৪৪৬ কোটি ২৭ লাখ ২৮ হাজার ৬৯৭ টাকা সম্পদের ক্ষতি হয়। আর ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপণের মাধ্যেমে ১ হাজার ৯৭৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭২ হাজার ৮৭৫ টাকার সম্পদ রক্ষা করে। এ ছাড়া এদিকে আগুন নির্বাপণের সময় ৩৭ জন বিভাগীয় কর্মী আহত এবং অগ্নি নির্বাপণ ও উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে ২ কর্মী নিহত হন। অগ্নি নির্বাপণের সময় উচ্ছৃঙ্খল জনতা ফায়ার সার্ভিসের ৩৪টি গাড়ি ভাঙচুর ও ৮টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।

অগ্নিকাণ্ডের কারণের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২৬ হাজার ৬৫৯টি আগুনের মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগে ৯ হাজার ৬৯টি ঘটেছে। এটি মোট আগুন লাগার ঘটনার ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ৪ হাজার ১৩৯টি (১৫.৫২%), চুলা থেকে ৩ হাজার ৫৬টি (১১.৪৬%), উচ্ছৃঙ্খল জনতার লাগিয়ে দেওয়া ৭৮৯টি (২.৯৫%), ছোটদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে ৭৫৯টি (২.৮৪%)। এর পাশাপাশি উত্তপ্ত ছাই থেকে ৭৩৫টি, গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে ৭০৪টি, গ্যাসের লাইন লিকেজ থেকে ৪৬৫টি, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে ৪৪টি, কয়েল থেকে ৪৫৫টি এবং আতশবাজি/ফানুস/পটকা পোড়ানো থেকে ৬৪টি আগুনের ঘটনা ঘটে। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বাসাবাড়ি বা আবাসিক ভবনে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সারা দেশে বাসাবাড়িতে মোট ৭ হাজার ১৩১টি আগুন লাগে, যা মোট আগুনের ২৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ ছাড়া খড়ের গাদায় ৪ হাজার ৫১৩টি (১৬.৯২%), রান্না ঘরে ২ হাজার ৪১১টি (৯.০৪%), দোকানে ১ হাজার ৮৮৭টি, হাটবাজারে ৯১১টি, শপিং মলে ৪৮১টি, পোশাকশিল্প ব্যতীত কলকারখানায় ৪৯৪টি আগুনের ঘটনা ঘটে। এর পাশাপাশি পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ২৩৬টি, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে ২১১টি, বহুতল ভবনের আগুন (৬ তলার ওপরে) ১৫৩টি, রেস্তোরাঁ ও হোটেলে ১৫০টি, কেপিআই ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১২৯টি, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ১২৬টি, পাট গুদাম-পাটকলে ১২৩টি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ৮৫টি, বস্তিতে ৮৪টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৭৮টি আগুনের ঘটনা ঘটে। পরিবহনে আগুনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে সারা দেশে বাস বাদে যানবাহনে ২৬৮টি, বাসে ১১৪টি, ট্রেনে ১৩টি, লঞ্চে ৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

মাসভিত্তিক অগ্নিকাণ্ডের পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০২৪ সালে ফেব্রুয়ারি (২৭২৩টি), মার্চ (৩৪২১টি), এপ্রিল (৩৪২৬টি), মে (২৬৮৬টি) এই চার মাসে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এই চার মাসে গড়ে প্রতিদিন ১০২টি করে আগুন লেগেছে। এ ছাড়া জানুয়ারি মাসে ২ হাজার ৫১৪টি, জুলাই মাসে ১ হাজার ৪২৭টি, আগস্ট মাসে ২ হাজার ১৬৩টি আগুন লাগে। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডে আহত-নিহত ব্যক্তিদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আহত ও নিহতদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। সারা দেশে ৩৪১ জন আহতের মধ্যে পুরুষ ২৩৭ ও নারী ১০৪ জন এবং নিহত ১৪০ জনের মধ্যে ১০৭ জন পুরুষ ও ৩৩ জন নারী। এ ছাড়া আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাসাবাড়ি/আবাসিক ভবনে (আহত ৭২, নিহত ৩৬), গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ (আহত ৫৩, নিহত ৮) এবং রেস্তোরাঁ ও হোটেলে (আহত ৭৮, নিহত ৪৭) আগুনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়েছেন। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ২০২৪ সালে সারা দেশে ডুবুরি কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৫৬ জন আহত ও ৭৫০ নিহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে। আরও ৩০৩টি পশু, ৫০টি পাখি, ২২৭টি প্রাণি উদ্ধার করে।

২০২৪ সালে সারা দেশে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ৯ হাজার ১২৮টি দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজ পরিচালনা করে ১০ হাজার ৮২৬ জন আহত ও ২ হাজার ৪৩৭ জন নিহতদের উদ্ধার করে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৪০৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৩১৯ জন আহত ও ১ হাজার ৪৮৪ জন নিহতদের উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। সারা দেশে অগ্নি প্রতিরোধব্যবস্থা জোরদার করতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ২০২৪ সালে ১৪৭টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। এই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৫৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া ৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অগ্নিদুর্ঘটনা কমানোর জন্য সারা দেশে জনগণকে সচেতন করতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ২০২৪ সালে ১৮ হাজার ৯৮৩টি মহড়া, ৩০৩৬টি জরিপ, ১৫ হাজার ৬৮৩টি গণসংযোগ করেছে।

এদিকে রাজধানীজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ১৭টি সুপারিশ করেছিল। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কোনো সংস্থার নজর নেই। ফলে ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন বা আলোর মুখ দেখেনি। প্রতি বছরই বড় ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া জোরদার করা, ‘অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগত মান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিন গিয়ে পরীক্ষা করা, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়নিক জাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দফতরের পরিবর্তে সব দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকাণ্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকাণ্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলোকে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা প্রভৃতি। দমকল বাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটা সময় তৈরি পোশাক কারখানা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে ছিল। এখন বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগুনের ঘটনা ঘটছে।

শাহজাদপুরে গত সোমবার আবাসিক হোটেলে আগুনে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ঢাকা জোনের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান জানান, রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী বিল্ডিংটি তৈরি করা হয়নি। ভবনটিতে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। সিঁড়িগুলো ছিল সরু। সিঁড়ির পাশে যে জানালা ছিল সেগুলো কাচ দিয়ে বন্ধ করা ছিল। কাচ দিয়ে বন্ধ না থাকলে ধোঁয়া বের হয়ে আসতে পারতো। এগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, মালিক কর্তৃপক্ষের কাউকে আমরা পাইনি। তদন্ত করে আগুনের প্রকৃত কারণ জানা যাবে।