তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : দেশে নানা কারণে নির্বিচার গণপিটুনীর ঘটনা বেড়েছে। গত আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এই সাত মাগেণ গণপিটুনীর শিকার হয়ে মারা গেছেন ১২৭ জন। এসময় আহতও হয়েছেন অগনিত। শুধুমাত্র চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গণপিটুনীর ঘটনা ঘটেছে ৭টি। এতে ৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের (২০২৪) আগস্ট থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত গণপিটুনিতে ১২৭ জন নিহত হয়েছেন। আরেক মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে গণপিটুনিতে সর্বোচ্চ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে গত বছর। ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হন ১৪৬ জন, যা আগের বছরের প্রায় তিন গুণ। ২০২৩ সালে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন।
মানবাধিকারকর্মীদের মতে, গত ৫ আগস্টের পর ‘মব ভায়োলেন্স’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতার পরিমাণ বেড়ে গেছে। তারা গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গণপিটুনির মতো এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনটি কারণ আছে বলে মনে করেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মো. সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, প্রথমত, এটি ঘটছে পরিকল্পিত উসকানির কারণে। সরকারের সহযোগী বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় কিছু ব্যক্তি এতে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা একটা বড় কারণ। হয়তো ইচ্ছা করেই এ বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। সর্বোপরি সরকারের উদাসীনতা ও কোনো পদক্ষেপ নিতে অনীহার কারণেই বেড়ে যাচ্ছে গণপিটুনির প্রবণতা।
আইনজীবীরা বলছেন, গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিত্রকেই তুলে ধরে। দিনের পর দিন এসব ঘটনা বাড়লেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ তাদের।
সাম্প্রতিক ঘটনা : সর্বশেষ ঘটনা ঘটে ২৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার। ওইদিন রাত সাড়ে ১১ টার দিকে শরীয়তপুরের কীর্তিনাশা নদীতে বাল্কহেডে ডাকাতির চেষ্টার সময় গণপিটুনিতে দুইজন নিহত হয়েছেন। এ সময় ডাকাতদের ছোড়া হাতবোমা ও গুলিতে আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। ডোমসার ইউনিয়নের তেতুলিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাতে একদল ডাকাত মাদারীপুরের রাজারচর এলাকায় বাল্কহেডে ডাকাতির চেষ্টা করে। বিষয়টি টের পেয়ে তাদের ধাওয়া দেয় স্থানীয়রা। ডাকাতরা পালিয়ে শরীয়তপুরের তেতুলিয়া এলাকায় এলে স্থানীয়রা বাল্কহেড দিয়ে তাদের স্পিডবোটের গতিপথ রোধ করেন। ডাকাতির খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এলাকায় মসজিদে মসজিদে করা হয় মাইকিং। মুহূর্তেই শতশত মানুষ ডাকাতদের ঘিরে ফেলে। এ সময় ডাকাতদের ছোড়া হাতবোমা ও এলোপাতাড়ি গুলিতে বেশ কয়েকজন আহত হন।
পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, “স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে ডাকাতরা স্পিডবোট ফেলে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় সাতজনকে আটক করে পিটুনি দিয়ে পালং মডেল থানা-পুলিশের হাতে তুলে দেয় জনতা।”
এর আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাত ৯ টার দিকে রাজধানীর উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গণপিটুনি দিয়ে ফুটব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরদিন বুধবার পুলিশ উদ্ধার করে দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, একদল মানুষ ঝুলে থাকা দুই ব্যক্তিকে মারধর করছেন।
একইদিন টঙ্গীতে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে।
এর আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের মসজিদের মাইকে বাড়িতে ডাকাতের হানা দেওয়ার ঘোষণায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। ওইদিন রাতে উত্তেজিত জনতার মারধরে আহত হয়েছেন একজন এবং দুই জনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছেন কর্ণফুলী থানার ওসি শরিফুল ইসলাম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে গেণা সদস্যরাও উপস্থিত হয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ওই শরিফুল ইসলাম বলেন, “ডাকাতির ঘটনা নয়, পূর্ব বিরোধের জেরে চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভী বাজারের বাসিন্দা খোরশেদ আলমের বাড়িতে গিয়ে ভাংচুর চালিয়েছে দুইজন। খোরশেদ তার বাড়িতে ডাকাত পড়েছে বলে এলাকাবাসীকে জানালে তারা মাইকে ঘোষণা দিয়ে ওই বাড়ি ঘেরাও করেছিল। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের গ্রেপ্তার একজন দাবি করেছেন তিনি খোরশেদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা পাওনা আছেন। সে টাকা আনতে রাতে তারা খোরশেদের বাড়িতে যান এবং ভাংচুর করেন।
এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙার মধ্যেই উৎসুক জনতার ভিড়ে আওয়ামী লীগ সন্দেহে এক নারীসহ দুইজনকে গণপিটুনি দিয়েছে ছাত্র-জনতা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাদেরকে গণপিটুনি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানিয়েছেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় এক নারীকে এবং কথা বলার সময় ‘আপার বাড়ি’ বলায় এক পুরুষের ওপর হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। একপর্যায়ে তাদের মারতে মারতে ধানমন্ডি-৩২ থেকে প্রধান সড়কে নিয়ে যায়। পরে এক ফটোসাংবাদিকসহ কিছু লোকজন তাদেরকে রিকশায় উঠিয়ে দেন।
এর আগে ৪ ফেবব্রুয়ারি শেরপুরের নকলায় গরুচোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে দুইজনকে। গুরুতর আহত হয়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন আরও চারজন। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে শেরপুর-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ নকলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. আব্দুল করিম।
স্থানীয়দের বরাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, রাতে রাস্তার পাশে ওই ছয়জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা ‘গরু চোর’ বলে চিৎকার শুরু করেন। এতে কয়েকশ লোক জড়ো হয়ে তাদেরকে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ছয়জনকে উদ্ধার করে নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুসলিম উদ্দিন।
এর আগে ২২ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওইদিন সকাল ৯টার দিকে উপজেলার জাদুরাণী বাজারে এ ঘটনা ঘটে বলে হরিপুর থানার ওসি জাকারিয়া মণ্ডল জানান।
স্থানীয়দের বরাতে পুলিশ জানায়, জাদুরাণী বাজার এলাকায় মোটরসাইকেল চুরির সময় রুবেলকে ধরে ফেলে জনতা। পরে তাকে গণপিটুনি দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় রুবেলকে হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গণপিটুনি আইনের দৃষ্টিতে ‘হত্যা’ : গণপিটুনি আইনের দৃষ্টিতে ‘হত্যা’ এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা হত্যাকারী হিসেবেই চিহ্নিত হন, এমনটাই মত দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক। তার মতে, দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক পরিবেশ, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা ও ভীতি এবং আমলাতন্ত্রকে পরিচালনায় অদক্ষতাই গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার কারণ। তিনি বলেন, ‘গণপিটুনি এখন বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো প্রচেষ্টা সরকারিভাবে দেখছি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের চাকরি ও বদলি নিয়ে তটস্থ। আমলাতন্ত্র পরিচালনাও যথাযথ নয়।’