ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবি শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ রাব্বীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবরের পৈশাচিক এ হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল একদল ষড়যন্ত্রকারী। তারাও একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। গতকাল রোববার আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে ৫ জনের যাবজ্জীবনও বহাল রাখা হয়েছে।

আবরার হত্যাকাণ্ড বুয়েটের জন্য স্পষ্টতই একটি কলঙ্কিত অধ্যায়, তা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রিয় বিদ্যাপীঠে নিজের হলে আবরারকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে অন্য সহপাঠীদের হাতে। আর এ হত্যার ঘটনার মাধ্যমে বের হয়ে এসেছে বুয়েটের মতো শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের এক বীভৎস অধ্যায়। ছাত্রলীগের বর্বরতা কোন পর্যায় পৌঁছতে পারে তা আবরার হত্যাকান্ডটি একটি দৃষ্টান্ত।

যা ঘটেছিল সেদিন : ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে আবরার ফাহাদকে উদ্ধার করা হয়। এর দুইদিন আগে ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন আবরার ফাহাদ। এর জেরে পরদিন ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। তারা আবরারের ১০১১ নম্বর কক্ষে গিয়ে রাতে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তার ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইলসহ ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। এরপর ওই কক্ষে আবরারকে নির্যাতন করা হয়। পরে রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আবরার হলের যে কক্ষে থাকতেন, ওই কক্ষ ও আশপাশে কক্ষগুলোর কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছুটি কাটিয়ে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে ৬ অক্টোবর বিকেলে নিজের ক্যাম্পাসে ফেরেন আবরার। ওই দিন বিকেলের দিকে শেরেবাংলা হলে নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষে পৌঁছে ফোনে মায়ের সঙ্গে কথাও বলেন। শিক্ষার্থীরা জানান, বাড়ি থেকে ফিরে আবরার নিজের কক্ষেই পড়ালেখা করছিলেন। ৬ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আবরারের কক্ষে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ২০১১ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষে থাকেন ছাত্রলীগের চার নেতা। সেখানে তার মোবাইল ফোন তল্লাশি করেন নেতারা। ওই কক্ষে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ। তারা আবরারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সেটি যাচাই করেন। এক পর্যায়ে আবরারকে তার ফেসবুক আইডি লগ-ইন করতে বলেন। পরে তারা তার ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে আবরার কোনো সংগঠন না করলেও তাকে পরিকল্পিতভাবে শিবিরের নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন। এর পরই ওই দুই নেতার সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজন তাকে মারধর শুরু করেন। আবরারকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয়। ‘শিবির ধরা হয়েছে’- এমন খবর পেয়ে সেখানে সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারী আরও সাত থেকে আটজন নেতা জড়ো হন। তারাও সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে যায় আবরারের দেহ। রাত ২টার পর তাকে ওই কক্ষ থেকে বের করে হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়। একজন শিক্ষার্থী জানান, ২০১১ নম্বর কক্ষ থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চিৎকার ভেসে আসছিল। তবে ঝামেলা এড়াতে তিনি ওই কক্ষে যাননি। কক্ষটিতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাসহ তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিল। তারাও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সকালে বুঝতে পারেন, সেখানে আবরারকে হত্যা করা হয়েছে। অপর দু’জন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, পেটাতে পেটাতে আবরারকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের নেতারা। তিনি তাতে রাজিও হন। এরপরও তাকে ছাড়া হয়নি; নৃশংস ও নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আবরারকে হত্যার ঘটনা জানাজানির পর হলজুড়েই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহত ওই ছাত্রের রুমমেট ও সহপাঠীরাও এ বিষয়ে প্রথমে মুখ খুলতে চাননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবরারের কয়েকজন সহপাঠী জানান, হত্যার পর দীর্ঘক্ষণ আবরারের লাশটি ২০১১ নম্বর কক্ষেই পড়ে ছিল। রাত ২টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী তার নিথর দেহ নামিয়ে আনেন। এক পর্যায়ে নিচতলা ও দোতলার মাঝখানের সিঁড়িতে তার লাশটি ফেলে রাখা হয়। হলের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ মোস্তফা সে সময় দাবি করেন, প্রতি রাতেই শিক্ষার্থীরা নানা বিষয়ে কমবেশি হৈ-হুল্লোড় করেন। কিন্তু রোববার (ঘটনার দিন) রাতে তিনি কোনো চিৎকার শোনেননি। বিষয়টি গভীর রাতে জানতে পারেন তিনি।

বুয়েটের শেরেবাংলা হলের একজন আবাসিক ছাত্র সে সময় জানান, তিনি রাত ২টার দিকে পানি আনতে গিয়ে দেখেন নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির মাঝে তোশকের ওপর আবরারের নিথর দেহ পড়ে আছে। তখন সেখানে ছাত্রলীগের অন্তত তিনজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। এতে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ঘটনা জানাজানি হয়। তখন সবাই হলের চিকিৎসকদের খবর দেন। চিকিৎসক এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। অ্যাম্বুলেন্স ডাকার এক পর্যায়ে চিকিৎসক জানান, আবরার আর নেই, মারা গেছে। ততক্ষণে ছাত্রলীগের ওই কর্মীরা পালিয়ে যান। ওই সময়ে হলের প্রভোস্টও ঘটনাস্থলে আসেন। বুয়েটের চিকিৎসক মাশরুক এলাহী সে সময় জানান, খবর পেয়ে তিনি রাত ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পারেন- ছেলেটি বেঁচে নেই। ঘটনার বিষয়ে পরদিন হলের প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খান জানান, এক শিক্ষার্থী হলের সামনে পড়ে আছে খবর পেয়ে তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান। শরীরে আঘাতের চিহ্ন পেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশে খবর দেন। তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। শরীরের ভেতরে রক্তগুলো জমাট বেঁধে কালো হয়ে গিয়েছিল। সময় যত গড়াতে লাগল, ততই নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডের মুখোশ উন্মোচিত হতে লাগল। রহস্যজনক সেই মৃত্যুর জের ধরে এমন এক খুনের বর্ণনা সামনে এল, যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তখন গোটা দেশ। জানা গেল, নিজের হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে খুন হয়েছেন আবরার।

ভিডিও ফুটেজে যা দেখা গেছে: আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পরদিনই আন্দোলনে নামে বুয়েট শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বুয়েটের হলে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকায় ঘটনার ফুটেজ সংগ্রহে নামে শিক্ষার্থীরা। ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায় হল প্রশাসন থেকে। তবে ঘটনার পুরো ভিডিওর দাবিতে প্রাধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের দাবির মুখে পুরো ভিডিও তুলে দেওয়া হয়। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, আবরারকে মারধরের পর কক্ষ থেকে বের করা হয়। প্রথমে একজনকে বারান্দা দিয়ে কিছুটা দৌড়ে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়। এরপর তিনি একই পথে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর আবরারকে তিনজন ধরাধরি করে নিয়ে আসেন। তাদের পেছনে একজনকে হেঁটে আসতে দেখা যায়, তার পেছনে আরেকজন হেঁটে আসেন। এর পরপরই আরও পাঁচজনকে ওই বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখা যায়। ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী ওই দিন রাতে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সন্দেহে ১৯ জনের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা প্রত্যকেই বুয়েটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

বুয়েটে নিষিদ্ধ ছাত্ররাজনীতি: আবরারের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কেউ হারিয়েছে সহপাঠী, কেউ হারিয়েছে বন্ধু, কেউ অনুজ, কেউবা হারিয়েছে তার অগ্রজকে। সবাই যেন এক হয়ে যায় আবরার হত্যার বিচারে। সেই সঙ্গে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে শনাক্তকারী খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত করা সবাইকে ১১ অক্টোবর, ২০১৯ বিকেল পাঁচটার মধ্যে আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে, বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে ও আবাসিক হলগুলোতে র‌্যাগের নামে ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধে করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পঞ্চম দিনে ১১ অক্টোবর বিকেলে বুয়েট অডিটোরিয়ামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক বৈঠকে উপাচার্য তাদের এসব দাবি পূরণের কথা জানান। বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে আবরার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ শিক্ষার্থীকে বুয়েট থেকে সাময়িক বহিষ্কার করার কথা জানান উপাচার্য।