নিক্কেই এশিয়া বলছে, যদিও আকারে অনেক ছোট তবু ঐতিহ্যগতভাবে বৈরী সম্পর্ক থাকা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের পথে নিয়ে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর দুই মাস পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তান প্রথমবারের মতো নিয়মিত কার্গো শিপিং রুট চালু করেছে, যা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে একটি মাইলফলক। ডিসেম্বরে সাত বছরের বিরতির পর দুই দেশের মধ্যে পুনরায় সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়। নতুন বছরেও সম্পর্কোন্নয়নের এই গতি অব্যাহত আছে। জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সফর করেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল। ঢাকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে যৌথ পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)- এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার। যার প্রধান অংশ ছিল তুলা ও পাট। অর্থাৎ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে তুলা এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পাট রপ্তানি করা হতো। ফেব্রুয়ারিতে জাপান সফরের সময় দুই দেশের সহযোগিতায় অন্যান্য সম্ভাবনার ওপর জোর দেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। বিশেষ করে চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে জোর দিয়েছেন তিনি। চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে বিশাল রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কারখানার কাঠামো রয়েছে। তবুও আমাদের চিনি আমদানি করতে হয়। কারণ আমাদের নিজস্ব উৎপাদন যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানের বিনিয়োগ আমাদের বিদ্যমান কারখানাগুলোকে আধুনিকীকরণ করতে এবং বাংলাদেশের বাজারে চাহিদা মেটাতে সাহায্য করতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমরা অবশ্যই সেই খাতগুলোকে কাজে লাগাতে পারি, যেখানে পাকিস্তান অত্যন্ত দক্ষ।
শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়ন নয় বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্ক সামরিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে। জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করেন। যৌথ সামরিক মহড়া ও অস্ত্র স্থানান্তর নিয়ে আলোচনা করেন তারা। একই সঙ্গে পারস্পরিক বৃত্তি কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থী বিনিময় এবং ঢাকায় পাকিস্তানের একজন খ্যাতনামা শিল্পীর পরিবেশনা দুই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে। এসকল কিছুর পরেও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক দীর্ঘ ও জটিল ঐতিহাসিক পটভূমিতে আবদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয় বৃটিশ শাসিত ভারত। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নাম হয় ভারত আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পাকিস্তান নামে গঠিত হয়। নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রটি ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত ছিল। যার একাংশের নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান)। আর অন্য অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। এ দুই অংশকে বিভক্ত করে ভারত।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যেখানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন প্রদান করে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় এসে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের অঙ্গীকার করেন। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতি বিশেষ সুবিধা প্রদানকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের ক্ষোভ থেকে উদ্ভূত গণবিক্ষোভের পর গত আগস্টে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৫ বছরের শাসনকালে তার কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণে জনগণের ক্ষোভ ভারতের দিকেও প্রসারিত হয়, কারণ ভারত ছিল তার প্রধান সমর্থক।
বাংলাদেশকে স্থিতিশীল করার দায়িত্বে রয়েছে অন্তর্বর্তী ড. ইউনূস প্রশাসন। আর তাদের সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন ভারতে পালিয়ে থাকা হাসিনা। তার সম্ভাব্য প্রত্যর্পণ ইস্যু নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সরাসরি আলোচনা না করলেও, ইউনূস গত ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠক করেন। মিশরে অনুষ্ঠিত ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে হওয়া ওই বৈঠকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সত্যিই আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চাই। জবাবে, ড. ইউনূস সার্ক পুনরুজ্জীবিত করা এবং ঢাকায় এর শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দেন। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সার্ক একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। আটটি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে এটি গঠিত। যদিও সার্কভুক্ত দেশগুলো একত্রে বিশ্ব জিডিপির মাত্র ৪ শতাংশ অবদান রাখে। তারা বিশ্ব জনসংখ্যার ২৫ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো শীর্ষ সম্মেলন না হওয়ায় সংস্থাটি কার্যত নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। ১৯৮০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
ভারত শুরুতে এই প্রস্তাবকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। অঞ্চলের প্রধান শক্তি হিসেবে ভারত বহুপাক্ষিক আলোচনার পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকে অগ্রাধিকার দিত। কেননা ভারত মনে করত সম্মিলিত পদক্ষেপ এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিজ-এর নির্বাহী সহ-সভাপতি মায়ুমি মুরায়ামা বলেন, গত এক দশক ধরে ভারত ও বাংলাদেশ এমনভাবে তাদের সম্পর্ক পরিচালনা করেছে যেন দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের কোনো অস্তিত্বই নেই। তিনি মনে করেন, ইউনূসের সার্ক পুনর্জাগরণের পরিকল্পনা পাকিস্তানকে আবার দক্ষিণ এশিয়ার কাঠামোয় ফিরিয়ে আনার এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থাকে হাসিনা-পূর্ব যুগে ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন ইউনূসের এই উদ্যোগকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রসারে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভূমিকার পুনরুজ্জীবনকে প্রতিফলিত করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেকে এমন একটি শক্তি হিসেবে পুনর্গঠন করছে যা সব দেশের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। বিপরীতে নির্দিষ্ট শক্তির (ভারতের) সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতিকে সম্পৃক্ত করতে চায়না। তবে, নয়াদিল্লির সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক প্রোগ্রেসের জ্যেষ্ঠ গবেষক কনস্টান্টিনো জেভিয়ার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ভারত সার্কের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হবে না, যতক্ষণ না এটি পাকিস্তানের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। এটি গত প্রায় ১০ বছর ধরে ভারতের নীতি এবং এটি পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা কম, যদিও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে আশা ও আবেদন জানাচ্ছে। সার্ক পুনরুজ্জীবিত করতে ইউনূসের প্রচেষ্টা বিস্ময়কর, কারণ বাংলাদেশই বিমসটেকের সদর দফতরের স্বাগতিক দেশ, যা একটি বিকল্প আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা এবং যা বাংলাদেশের ভূ-অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত বলে মনে করেন জেভিয়ার। বলেন, তাই সার্কের ওপর এই নতুন মনোযোগ হয়তো কেবল তার আঞ্চলিক সহযোগিতার পুরনো ধারণার প্রতিফলন, অথবা এটি একটি রাজনৈতিক প্রচেষ্টা যা হাসিনার বিমসটেক-কেন্দ্রিক নীতির বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং ভারতকে চ্যালেঞ্জ করার কৌশল হতে পারে।