রাজধানী
আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা
আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ !
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আবার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আজ সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন
Printed Edition
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আবার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আজ সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন পাওয়ার পর সেটি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজউকের এই উদ্যোগ লাভবান করবে আবাসন ব্যবসায়ীদের। ফলে আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রয়াস স্বপ্নই থেকে যাবে। রাজধানীবাসীর কাক্সিক্ষত নাগরিক সুবিধাও অধরা থাকবে ।
সূত্র মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ণে ঢাকা এখন দুর্ভোগের নগরী। এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০২২-২০৩৫ সময়ের জন্য প্রণয়ন করেছে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ। তবে শুরু থেকেই এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তিতে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীবাসী বলছেন, বর্তমানে বিভিন্ন এলাকা বসবাসের অনুপযোগী। দুটি ভবনের মাঝে কিঞ্চিৎ পরিমাণও জায়গা থাকে না। এতে ভবনে আলো-বাতাস আসা-যাওয়ার সুযোগ না থাকায় অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকছে। জায়গার অভাবে খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না শিশুরা।
জানা গেছে, নতুন পরিকল্পনায় যত্রতত্র বহুতল ভবন নির্মাণ করা যাবে না। বরং এলাকা ভিত্তিক ফার বা ফ্লোর এরিয়া রেশিও ঠিক করে দিয়েছে রাজউক। যে এলাকায় ফার যত বেশি, ভবনের উচ্চতাও ততো বেশি। তবে আবাসন ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে ড্যাপ সংশোধনে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকারি সংস্থাটি। বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ফারের মান ও ফ্ল্যাটের সংখ্যা। রাজউক বলছে, যানজট, পরিবেশ ও আবাসন সমস্যাকে প্রাধান্য দিয়েই করা হচ্ছে নতুন সংশোধনী।
ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ১০ মার্চ সোমবার ড্যাপের খসড়া উপস্থাপনের কথা রয়েছে। সভায় কোনো সংশোধনী এলে সেটি সংশোধন করে পরবর্তীতে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। এই উদ্যোগের সমালোচনা করে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, প্রস্তাবিত সংশোধনী আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থ হাসিল করবে। ঝুঁকির মুখে ফেলবে ঢাকা মহানগরীকে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ভারবহন ক্ষমতা থেকে ৪-৫ গুণ বেশি মানুষ ঢাকায় বাস করেন। এ পরিস্থিতিতে আরও নতুন ভবন নির্মাণ করে মানুষের বসবাসের সুযোগ তৈরি হলে ঢাকা ঝুঁকির মুখে পড়বে। তখন কোনো বিনিয়োগ করেই এটি ঠিক করা যাবে না।
এদিকে ড্যাপ সংশোধন ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা চূড়ান্ত না করলে আবাসন খাতের সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব। তবে কী ধরনের আন্দোলনে যাবেন সেই বিষয়ে স্পষ্ট করেননি তারা। সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন রিহ্যাব নেতারা। এখানে লিখিত বক্তব্যে রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেছেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের করা নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতা কমানোর কারণে আবাসন খাতে নতুন বিনিয়োগ থমকে গেছে। উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্প নিতে পারছে না। ফলে কাজ না থাকায় অনেকেই বেকার হয়ে পড়ছেন। এই বেকার জনগোষ্ঠীর অনেকে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। নতুন ড্যাপের কারণে ঢাকা মহানগরের ৮০ শতাংশ অপরিকল্পিত থেকে যাবে এমন মন্তব্য করে ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, জনসংখ্যাবহুল এ দেশে কোনোভাবেই ভবনের উচ্চতা কমানো কাম্য নয়। উচ্চতা কমে যাওয়ার কারণে শহর একটা মরণফাঁদে পরিণত হতে যাচ্ছে। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে বহু মানুষের মানুষের প্রাণহানি হবে। উদ্ধারকর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারবেন না।
সূত্র মতে, নগরী বাসযোগ্য করতে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাজধানীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫ (ড্যাপ)-এর গেজেট হয় ২০২২ সালের আগস্টে। এর পরই শুরু হয় বিতর্ক। এক বছর না যেতেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ভবনের উচ্চতায় তিন বছরের জন্য ছাড় দিয়ে ড্যাপ সংশোধন করে। অন্তর্বর্তী সরকারও ড্যাপ সংশোধনের পাশাপাশি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২৫ অনুমোদনের উদ্যোগ নেয়। গঠন করে নতুন টেকনিক্যাল কমিটি। তবে এতে নগর পরিকল্পনাবিদদের বাদ দিয়ে অংশীজন হিসেবে রাখা হয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের।
জানা যায়, কোন পদ্ধতিতে ড্যাপ সংশোধন হবে, তা স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে গেজেট হওয়ার সময়ই। এ লক্ষ্যে পেশাজীবীদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের একটি কমিটিও করেছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি), বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইইবি) ও ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) দুজন করে প্রতিনিধিসহ রাজউকের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে এ কমিটি করা হয়। ড্যাপ সংশোধনের প্রয়োজন হলে তারা সরকারকে সুপারিশ করবেন। সে অনুযায়ী হবে সংশোধন। জুলাই অভ্যুত্থানে সরকারের পালাবদলের পর ড্যাপ সংশোধনের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি করে গৃহায়ন মন্ত্রণালয়। মতামত দেয়ার জন্য ওই কমিটির সভাগুলোয় পেশাজীবীদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আবাসন ব্যবসায়ীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণসংক্রান্ত বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ীরা ভোক্তা হিসেবে মতামত দিতে পারবেন, কিন্তু বিধিমালা কীভাবে প্রণয়ন হবে সে বিষয়ে তাদের মত দেয়ার অধিকার নেই।
আবাসন ব্যবসায়ীদের নগর পরিকল্পনার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অংশীজন হিসেবে রাখায় নগরে আরো বেশি বৈষম্য তৈরি হবে বলে মনে করেন স্থপতি ইনস্টিটিউটের (আইইবি) ড্যাপবিষয়ক কমিটির সাবেক আহ্বায়ক স্থপতি ইকবাল হাবিব। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, নগর পরিকল্পনার নীতিমালা প্রণয়ন সভায় আবাসন ব্যবসায়ীদের বসার সুযোগ দিয়ে অন্যায় করেছে সরকার। কেননা রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) হলো ড্যাপ ও ইমরাত নির্মাণ বিধিমালার ভোক্তা। গণশুনানির সময় ভোক্তা তার দাবি-দাওয়ার বিষয়ে যত খুশি বলতে পারবে, কিন্তু পলিসিসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ঠিক করবেন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা। এখানে হয়ে গেছে উল্টো, আবাসন ব্যবসায়ীরাই এখন তাদের ব্যবসার নীতি-নৈতিকতার পলিসি ঠিক করছেন। অন্যদিকে কখনো কখনো পেশাজীবীদের কোনো কোনো সংগঠনকে পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণের বাইরে রাখা হচ্ছে। স্থপতি ইকবাল হাবিব আরো বলেন, ড্যাপ কেবল পরিকল্পনাবিদদের বিষয় নয়, অর্থাৎ এখানে স্থপতি ও প্রকৌশলীরাও এর অংশীজন। তেমনি পরিবেশবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য বিশারদরাসহ অন্যরাও সে প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জোরালো ভূমিকা রাখার দাবি রাখে। কিন্তু রিহ্যাব কোনোভাবেই ড্যাপ বা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার প্রণয়নে অংশীজন নয়।
ড্যাপ সংশোধন ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়নসংক্রান্ত কমিটি থেকে নগর পরিকল্পনাবিদদের সুকৌশলে বাদ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন বিআইপি সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর পরই ড্যাপ রিভিউর জন্য একটা মিটিং ডাকে। সেখানে আমরা অল্প কয়েকজন পরিকল্পনাবিদ ছিলাম। অন্যরাও ছিলেন। কিন্তু গিয়ে দেখি ২০ জনের মতো আবাসন ব্যবসায়ী সেখানে উপস্থিত। এর আগে কখনো নগর পরিকল্পনার টেকনিক্যাল মিটিংয়ে তাদের দেখিনি। তারা ওই সভায় পরিকল্পনাবিদদের ওপর রীতিমতো চড়াও হন। অন্যায্য, বৈষম্যমূলক এবং নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে সুস্পষ্ট স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকায় আমরা পরবর্তী সভা বয়কট করি।
জানা গেছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২৫ খসড়া যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গত ৬ জানুয়ারি কমিটি গঠন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সে কমিটির অধীনে ৬ ফেব্রুয়ারি একটি বৈঠক হয়। সেখানে আমন্ত্রিতদের তালিকায় কোনো পরিকল্পনাবিদ না থাকলেও ছিলেন আবাসন ব্যবসায়ী দ্য স্টাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুল আউয়াল। আরো উপস্থিত ছিলেন স্থপতি কাজী গোলাম নাসের। ড্যাপ সংশোধন ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়নে পরিকল্পনাবিদদের বাদ দিয়ে বৈঠক করার বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বসবাস উপযোগিতার বিবেচনায় ঢাকার অবস্থান তলানিতে। এ অবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহলের কথায় ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করা হলে তা এই শহরের জন্য আত্মঘাতী হবে। তবে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংস্কার করা যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।
পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে জানায়, বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবার জন্য বাসযোগ্য নগর ও জনবসতি গড়তে দরকার নগর পরিকল্পনার প্রকৃত অনুশীলন ও কার্যকর বাস্তবায়ন। অথচ ব্যবসায়িক ও গোষ্ঠীস্বার্থে আবাসন ব্যবসায়ী ড্যাপ বাতিলের মাধ্যমে পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন করতে চায়, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
গত শনিবার রাজউকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম। ড্যাপ সংশোধনের বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি এ বিষয়ে এখনই কিছু বলবেন না বলে তার অফিস থেকে জানানো হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ড্যাপসহ রাজউকের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সাংবাদিক সম্লেলন করবেন বলে জানানো হয়।
এ বিষয়ে সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ছিদ্দিকুর রহমান সংগ্রামকে বলেন, বিদ্যমান ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করলে সেটা ভালো কোনো কাজ হবে না। সব পক্ষ খুশি থাকে এমন পর্যায়ে সংস্কার করা উচিৎ।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ড্যাপ সংশোধনী নিয়ে আজ সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের আলোচনা হবে। এজন্য ড্যাপে কোন বিষয়গুলো সংশোধনী আনা হবে সেগুলো প্রস্তুতি করা হয়েছে। আগের ড্যাপের বিষয়গুলোর কিছু খসড়ায় শীথিলতা আনা হয়েছে। রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে দুই ধরনের অনুমোদন নিতে হয়। প্রথমত, ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র। দ্বিতীয়ত, নির্মাণের অনুমোদন। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেয়া হয় ড্যাপ অনুসরণ করে। অন্যদিকে নির্মাণ অনুমোদন দেয়া হয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে। নতুন ড্যাপে দুটোই পরিবর্তন আনা হচ্ছে।