মিয়া হোসেন: অসংখ্য ঘটনার মাস পবিত্র রমযান। এমনই একটি ঘটনা মক্কা বিজয়। অস্টম হিজরী দশ রমযানের ঘটনা এটি। ইসলামের ইতিহাসে মক্কা বিজয়ের ঘটনা এমন একটি আযীমুশ শান ঘটনা, যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা তার দ্বীন এবং তার রসূলকে শক্তিশালী করেছেন। রসূল সা. এর সৈনিক এবং হারামে মাক্কীর সম্মান বৃদ্ধি করেছেন। এই বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা তার ঘর ও শহরকে এবং সমস্ত বিশ্ববাসীর হিদায়াতের কেন্দ্রস্থলকে কাফের-মুশরিকদের হাত থেকে মুক্ত করেছেন। এই বিজয়ে আসমানের অধিবাসীগণ খুশী হয়েছিল এবং এই বিজয়ের ফলেই দলে দলে লোক ইসলামে প্রবেশ করল।

অষ্টম হিজরীর রমযান মাসের দশ তারিখে নাবী সা. ১০ হাজার মুজাহিদের একটি বাহিনী নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে বের হলেন। বের হওয়ার সময় আবু রুহম কুলছুম বিন হুসাইনকে মদীনার খলীফা নির্বাচন করলেন। মক্কা আক্রমণ ও জয় করার কারণ হচ্ছে, কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করেছিল এবং খোযাআ গোত্রের উপর রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করে তাদেরকে অকাতরে হত্যা করেছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত মোতাবেক খোযাআ গোত্র রসূল এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। এটি ছিল হুদায়বিয়ার সন্ধির সুস্পষ্ট লংঘন।

ইসলামী বাহিনী যখন ‘মাওরাউজ জাহরান’ নামক স্থানে পৌঁছল তখন রাতের বেলা নাবী সাহাবীদেরকে আগুন জ্বালানোর আদেশ দিলেন। সাহাবী প্রজ্জ্বলিত আগুনের আলোতে আশে-পাশের সমস্ত অঞ্চল আলোকিত হয়ে গেল। তখনো মক্কাবাসীদের কাছে মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের কোন খবর ছিল না। তবে তাদের অন্তরে আশঙ্কা ছিল যে, যে কোন সময় মুসলিম বাহিনী মক্কায় আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তারা চলে আসবে- এটি তাদের ধারণায় ছিল না। অতঃপর নাবী সা. মুজাহিদ বাহিনীকে সাথে নিয়ে বিনা বাধায় মক্কায় প্রবেশ করলেন। প্রথমে তিনি কাবা ঘরের দিকে গেলেন। তার চার পাশে আনসার ও মুহাজিরগণ ঘিরে ছিল। কাবায় গিয়ে তিনি আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করলেন। রসূল সা. এর হাতে একটি ধনুক ছিল। সে সময় কাবার অভ্যন্তরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। ধনুকের মাধ্যমে এক এক করে তিনি মূর্তিগুলোকে ভেঙে ফেললেন। এ সময় তিনি কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করছিলেন- ‘‘বল, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল’’। (সূরা: বনী ইসরাইল) অতঃপর নাবী সা. কাবার ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সালাত পড়লেন। সালাত পড়ে বাইরে আসলেন। কুরাইশরা তখন সারিবদ্ধভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে অবস্থান করছিল। তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন- হে কুরাইশ সম্প্রদায়? তোমাদের সাথে আজ আমি কেমন আচরণ করব বলে মনে কর? সকলেই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে লাগল- আমরা আপনার কাছ থেকে খুব ভাল আচরণ কামনা করছি। ইউসুফ (আ.) তার ভাইদেরকে যা বলেছিলেন আজ আমিও তোমাদের সাথে তাই বলছি। আজ তোমাদের উপর কোন অভিযোগ নেই। তোমরা মুক্ত-স্বাধীন।

মক্কা বিজয়ের পর পুরো আরব ভূখণ্ডে এবং সারা বিশ্বে অল্পদিনের মধ্যে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম আবির্ভাবের পর দীর্ঘ এক দশক মুসলমানের ওপর মক্কাবাসীর সীমাহীন অত্যাচার এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-সহ অন্য মুসলিমদের দেশান্তরে বাধ্য করার পরও মহানবী (সা.)-এর উদারতায় বিস্মিত হয়। ফলে তাদের চোখ থেকে মিথ্যার আবরণ খসে পড়ে এবং ইসলামের সঙ্গে নতুন দিনের যাত্রা শুরু করতে আগ্রহী হয়।

মক্কাবাসীর আগ্রহ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের থেকে আনুগত্যের বাইআত গ্রহণ করেন। মূলত এ বাইয়াত ছিল নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার। পবিত্র কুরআনে বিবৃত অঙ্গীকারে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বিষয়ক অপরাধগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যা একটি নতুন বিজিত ও স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকরা বলেন, মক্কায় মুসলিম বাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর মক্কার অধিবাসীদের সামনে সত্য পরিষ্কার হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল ইসলাম ছাড়া সাফল্যের কোনো পথ নেই। ফলে তারা বাইয়াতের জন্য একত্র হলো। মহানবী (সা.) সাফার ওপর বসলেন এবং লোকদের বাইয়াত গ্রহণ করছিলেন। ওমর (রা.) তার নিচে ছিলেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষ থেকে যথাসম্ভব আনুগত্যের অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। পুরুষদের অঙ্গীকার গ্রহণের পর নারীদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। ওমর (রা.) রাসুল (সা.) থেকে একটু নিচু স্থানে বসে তার নির্দেশে বাইআত করাচ্ছিলেন এবং নারীদের কথা তার কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৪২৫)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, মহানবী (সা.) নারীদের থেকে ছয়টি অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। পবিত্র কুরআনে যা এভাবে বিবৃত হয়েছে, ‘হে নবী, মুমিন নারীরা যখন আপনার কাছে এসে এ মর্মে বাইয়াত করেÑতারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তান হত্যা করবে না, তারা সজ্ঞানে কোনো অপবাদ রটাবে না এবং সৎকাজে আপনাকে অমান্য করবে না, তখন আপনি তাদের বাইয়াত গ্রহণ করুন। আর তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, দয়ালু। ’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত : ১২)।