নিয়োগ জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানে বাংলা একাডেমিতে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। গতকাল সোমবার সকালে দুদকের একজন সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে এই অভিযান চালানো হয় বলে কমিশনের মহাপরিচালক মো. আকতার হোসেন জানান।
দুদকের হাতে আসা অভিযোগে বলা হচ্ছে, বাংলা একাডেমিতে ১৭৫ জন নিয়োগে ‘দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি’ হয়েছে। ২০২২ সালে তৎকালীন মহাপরিচালক নুরুল হুদাসহ সংশ্লিষ্টরা চাকরির আবেদন ফরম থেকে শুরু করে ‘পদে পদে দুর্নীতি’ করেছেন। এমনকি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে ১০ লাখ টাকা করে ঘুস নেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাংলা একাডেমির শূন্যপদ পূরণের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ১৮০টি শূন্য পদের জন্য যথাক্রমে ১০০, ২০০, ৪০০ ও ৬০০ টাকা আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে বলা হয়।
৫০ হাজারের বেশি চাকরিপ্রার্থী সেবার আবেদন করেন। প্রায় দুই কোটি টাকা বাংলা একাডেমির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, পরীক্ষা কেন্দ্র ভাড়া, পরীক্ষকদের সম্মানী তথা আনুসঙ্গিক ব্যয়ের পরও অর্ধকোটি টাকা বেঁচে যায়। মহাপরিচালক ও নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তারা নিজেদের ‘পারিশ্রমিক হিসেবে তা ভাগাভাগি করে নেন’ বলে দুদকের ভাষ্য।
দুদকের হাতে আসা অভিযোগে বলা হয়, চার হাজার প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখানো হয়। কিন্তু ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার ডাকা হয় তাদের ভেতর থেকে মাত্র ৫০০ জনকে। তাদের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ না করে ‘গোপনে’ ১৭৫ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় । তাদের মধ্যে ১৩৩ জন যোগ দিতে সক্ষম হয়। বাকিরা চাহিদা মত টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। যোগদান করা ১৩৩ জনের মধ্যে বাংলা একাডেমিতে আগে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করা ৮৪ জনের মধ্যে ৪৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সে সময় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পোষ্য ১৫ জন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আত্মীয় যেমন- স্ত্রী, ভাই, বোন, ভাগ্নে, ভাগ্নি, ভাতিজা, ভাতিজি ৩০ জন এবং নিয়োগ দাতা কমিটির কর্মকর্তা ও কার্যনিবাহী পরিষদের সদস্যদের সুপারিশে নিয়োগ পান ৩৪ জন।
দুদক বলছে, তাদের মধ্যে ৪২ জনকে ‘বয়সসীমা লঙ্ঘন করে’ নিয়োগ দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমির নিয়োগবিধি এবং প্রবিধানমালার শর্ত ‘সম্পূর্ণ উপেক্ষা’ করা হয় । চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগের জন্য জন্য ১০ লাখ টাকা দাম ওঠে। অন্যান্য প্রার্থীদের জন্যও বিপুল পরিমাণ অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। আর্থিক সুবিধা, রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে সবাইকে নিয়োগ দেওয়া হয়, বাংলা একাডেমির নিয়োগবিধি, পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি এবং প্রবিধানমালার শর্ত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, ‘অবৈধ’ নিয়োগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন প্রাক্তন মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা, ডা. খোন্দকার মুজাহিদুল ইসলাম (তৎকালীন পরিচালক, প্রশাসন, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগ), মো. হাসান কবীর (সিনিয়র পরিচালক ও সচিবের অবর্তমানে চলতি দায়িত্ব পালনকারী), মহাপরিচালকের পিএ আবুল কালাম আজাদ এবং কর্মকর্তা মিজানুর রহমান।
দুদক বলছে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বা দৈনিক মজুরিভিত্তিক জনবলের নামে দীর্ঘকাল ধরে বাংলা একাডেমিতে একটি ‘কুপ্রথা’ চালু আছে। রাজনৈতিক প্রভাব, কর্মকর্তাদের খেয়ালখুশি এবং কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদে এভাবে লোক নিয়োগ করা হয়। প্রথমে ৪ মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়; তারপর বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এভাবে দেখা যায় কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী এক নাগাড়ে ১০ বছর পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে চাকরি করে গেছেন। অমর একুশে বইমেলার স্টল ভাড়ার আয়, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির আয়, প্রেস থেকে আয়, ব্যাংক ভাড়া, ক্যান্টিন ভাড়া, এফডিআর, মিলনায়তন ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ভাড়ার আয় থেকে তাদের বেতন দেওয়া হয়। গত ১০ বছরে চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা একাডেমির নিজস্ব আয় থেকে দেওয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে বাংলা একাডেমির একজন সচিব এভাবে নিয়োগ ও বেতন নিয়ে আপত্তি তোলায় তাকে অন্যত্র বদলি করা হয় বলে দুদকের ভাষ্য।
অভিযানের বিষয়ে আক্তার হোসেন বলেন, এনফোর্সমেন্ট টিমের অভিযানে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হবে। রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণপূর্বক বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করা হলে সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে কমিশন।