শহীদ হাফেজ পাভেল ছিলেন একজন প্রতিবাদী তরুণ তুর্কি, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রকিবাদী কন্ঠস্বর। আর সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সবার সাথে যোগ দেন জুলাই আন্দোলনে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী বাহিনীর বন্দুক ও কামানের ভয় উপেক্ষা করে। কিন্তু ফিরলেন লাশ হয়ে পুলিশের গুলী কেড়ে নিল পাভেলের হাফেজ হওয়ার স্বপ্ন। ছেলেকে কুরআনের হাফেজ বানানোর যে স্বপ্ন দেখতেন তাঁর বাবা রফিক উদ্দিন ও মা দিলারা বেগম। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন আর কোনো দিন পূরণ হবে না। কারণ হাফেজ পাভেল তাদের বাবা-মায়ের স্বপ্নেরও আরও অনেক অনেক দূরে জান্নাতের মেহমান হয়ে চলে গেছেন মহান আল্লাহ কাছে। ছেলে হাফেজ হবে এই স্বপ্ন নিয়েই বাবা-মা পাবেল আহমদ কামরুলকে সিলেটের গোলাপগঞ্জের দক্ষিণ দারুল উলুম হুসাইনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে ছিলেন। শহীদ পাভেল দারুল উলুম হোসাইনিয়া মাদ্রাসা থেকে পবিত্র কুরআন শরিফ ২৮ পারা হিফজ করেছেন। তিনি সিলেট নগরীর গোটাটিকরের আনজুমানে তালিমুল কুরআন নামক প্রতিষ্ঠান থেকে কারিআনাও পড়েছেন। তাকে হারিয়ে এখনো কাঁদেন পরিবারের সদস্যরা। শহীদ পাভেল গোলাপগঞ্জের দক্ষিণ ইউনিয়নের কানিশাইল গ্রামের বাসিন্দা। ৫ আগস্ট ২০২৪ সিলেট নগরীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেন তিনি। নগরীর কিনব্রিজের পাশে গুলীবিদ্ধ হন। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরিবারের অভিব্যক্তি: সিলেট নগরীর পাশের উপজেলা গোলাপগঞ্জে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দূরে উত্তর কানিশাইল গ্রামে। গ্রামটি সালামগাঁ রোডের পাশে। এটি ৬নং ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের একটি গ্রাম। রফিক উদ্দিন একসময় ছোটোখাটো ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন শাকসবজির চাষ করে জীবন চালান। তাদের এলাকাটি মৌসুমী শাকসবজির জন্যে খুব বিখ্যাত। হাফেজ পাভেল (২৪) ছিলেন তার পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে চতুর্থ। রফিক উদ্দিনের অন্য সন্তানেরা হচ্ছেন, প্রথম পিপলু আহমদ, দ্বিতীয় টিপু সুলতান, তৃতীয় কন্যা মাসুমা আক্তার (বিবাহিত), চতুর্থ পাভেল এবং পঞ্চম সায়েল আহমদ। পাভেলের মা মোছাম্মত দিলারা বেগম। কানিশাইল গ্রামের হাফেজ পাভেল শহীদ হওয়ার পর থেকে পরিবারে কারোর মুখে হাসি নেই। পাভেলের বাবা রফিক বলেন, আমার ছেলেকে এভাবে হারাব তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমার অন্য ছেলেকে সরকারি চাকরি দেওয়া হলে শহীদ পাবেলের আত্মা শান্তি পাবে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে দিলারা বেগম বলেন, আরও কিছুদিন পর আমার ছেলে হাফেজ হয়ে যেত। আন্দোলনে গিয়ে আমার কলিজার টুকরা শহিদ হয়েছে। পাবেলের ভাই সুলতান বলেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর পরিবারে অন্ধকার নেমে এসেছে। জানা গেছে, পাভেলের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হলেও এখনো কোনো আসামীকে গ্রেফতার করা হয়নি। আমি চাই আমার ছেলেকে যারা হত্যা করছে তাদের বিচার হোক। ন্যায় বিচার পাইলে আমার মনে শান্তি পাবে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় যথাযথ বিচার চান শহীদ পাভেলের পরিবার।
জুলাই এর স্মৃতি আমরা ভুলতে পারি না, বলেন শহীদ পাভেল আহমেদ কামরুলের মামা। পাভেলের মামার বাসা সিলেট নগরীর কাজির বাজারে। এটি প্রায় দুশো বছরের পুরনো একটি বাজার। এখানে কাজিরবাজার জামেয়া নামে একটি মাদরাসার খুব সুনাম। পাভেল সেই মাদরাসায় পড়ার জন্যে গ্রাম ছেড়ে সিলেট নগরীতে চলে আসেন। থাকতেন মামার বাসায়। আর মাদরাসায় ভর্তির প্রস্তুতি হিসেবে একটি মুদির দোকানে পার্টটাইম জব নেন।
পাভেলের ভাই পিপলু বলেন, ৫ আগস্ট ২০২৪ বিকেল ৪টার দিকে আমরা গোলাপগঞ্জ উপজেলা সদরের চৌমুহনা নামক স্থানে। হাজার হাজার মানুষে ছেয়ে আছে চৌমুহনা চত্বর, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর আকাশ-বাতাস। সেনাবাহিনী শান্ত রাখছে জনতাকে। তখুনি আমাদের কাছে খবর আসে পাভেলের গায়ে গুলী লেগেছে। পাঁচ-সাত মিনিট পরই খবর আসে গুলীটা লেগেছে পাভেলের বুকে।
হাফেজ পাভেলের শহীদ হওয়ার ঘটনা: পরিবারের কাছ থেকে শোনা ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে, ৫ আগস্ট ২০২৪, বেলা ৩টা। সিলেট নগরী তখন স্বৈরাচারমুক্ত হতে চলেছে। নগরী জনতার পদভারে প্রকম্পিত। কিন্তু পুলিশ তখনো জনতার ওপর চালাচ্ছে গুলী। পাভেলরা তাদের মিছিল নিয়ে নগরীর চাঁদনিঘাট এলাকায়। ঘাটটি সুরমা নদীর পাড়ে। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী একটি স্থান। এখানে ত্রিভুজাকৃতির কোমরতক উঁচু একটি বাউন্ডারির ভেতরে ‘আলী আমজাদের ঘড়ি’ নামে গির্জার চূড়ার মতো শতবর্ষী পুরনো বিশাল ঘড়িঘর। পাশেই ‘কিন ব্রিজ’ নামে লোহার ব্রিজ।
পাভেলদের মিছিল ঘড়িঘরের কাছে আসতেই পুলিশ মিছিলের মানুষের ওপর গুলী চালায়। বুকে এসে গুলী লাগে পাভেলের। পাভেল ঘড়িঘরের বাউন্ডারির দেয়ালের ওপর ঢলে পড়েন। তার সাথে ছিলেন রাশেদ নামের কাজিরবাজারের আরেক ব্যবসায়ী, তার পায়ে গুলী লাগে। রাশেদের বয়স ২৭/২৮ বছর। তারপর সেবুল নামে কাজির বাজারের আরেক ব্যবসায়ী পাভেল ও অন্যান্য আহতকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যান। পাভেলের মামারাও ওসমানী হাসপাতালে যান। তারা সেখান থেকে নিয়ে আসেন পাভেলের প্রাণহীন দেহ। পাভেলের বাবা রফিক উদ্দিন পাঁচ বছর আগে স্ট্রোকের শিকার হয়েছিলেন। পাভেলের লাশ বাড়িতে আনার পর একবার পুত্রের মুখটা দেখেন। বুকে ধড়ফড় শুরু হয়। আর দেখেতে পারেননি।
রফিক উদ্দিনের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সুউচ্চ একটি পাহাড়ের চূড়ায় ‘গরিবুল্লাহ শাহ তের অলির মাজার শরিফ’-এর পাশে পাভেলকে দাফন করা হয়েছে। এদিকে রফিক উদ্দিন স্থানীয় পুলিশকে আসামী করে মামলা করেছেন। তাকে নিয়ে আমরা টিলা বেয়ে যখন চূড়ায় উঠি, দেখি চোখ দুটো ভেজা। আমরা যখন কবরের পাশ দাঁড়িয়ে দোয়া করছি, পাভেলের পিতার হাত দুটো আকাশের দিকে। তার চোখে তখন পানির বান ডেকেছে।