সরদার আবদুর রহমান : নদীর পানি-প্রবাহ সংক্রান্ত জাতিসংঘের কনভেনশনে বাংলাদেশ অজ্ঞাত কারণে এখনো অনুস্বাক্ষর করেনি। এতোদিন প্রতিবেশি দেশের আনুকূল্যপ্রাপ্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনীহার কারণে বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেনি। এই সনদে বাংলাদেশের পক্ষে এই সমর্থন ও অনুস্বাক্ষর করার এখনই উপযুক্ত সময় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এই কনভেনশনের বিষয়ে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে গৃহীত ‘হেলসিংকি রুলে’ ভু-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের বিষয়ে কোনো নীতমালার উল্লেখ ছিল না। পরে বিষয়টি জাতিসংঘের নজরে আসে। এর পর ১৯৭০ সালে পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা তৈরির জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ল কমিশন’কে দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিশন ১৯৯৭ সালে তাদের প্রস্তাবনা জমা দেয়ার পর জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিটি উপরোক্ত কনভেনশনের খসড়া প্রস্তুত করে এবং ১৯৯৭ সালের ২১ মে প্রস্তাবটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১০৬ ভোটে গৃহীত হয়। বাংলাদেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। তবে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘে পাস হওয়া এই সনদ অনেক দিন পর্যন্ত ‘অকার্যকর’ ছিল। কারণ কনভেনশনের নিয়ম অনুযায়ী অন্তত ৩৫টি দেশ অনুসমর্থন বা সংসদে ‘রেটিফাই’ করলে তার ৯০ দিন পর সনদটি কার্যকর হওয়ার কথা। ২০১৪ সালের ১৯ মে ভিয়েতনাম ৩৫তম দেশ হিসেবে এ সনদ অনুসমর্থন করে। ফলে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব সনদটি পরবর্তী ৯০ দিবসের অব্যবহিত পরে কার্যকর হওয়ার ঘোষণা দেন। সেই হিসাবে ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে সনদটি কার্যকর হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন একটি কনভেনশন নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উৎসাহী হওয়ার কথা ছিল। দুর্ভাগ্যবশত সনদটি পাসের সময় বাংলাদেশ এর পক্ষে ভোট দিলেও জাতীয় সংসদে এর অনুসমর্থন দশকের পর দশক ঝুলে রয়েছে।
বাংলাদেশের কী লাভ
প্রশ্ন উঠছে, এতে অনুস্বাক্ষর করলে বাংলাদেশের কী লাভ? এর উত্তর হলো, যেহেতু বাংলাদেশ তার নদীগুলোর উৎস নিয়ে বড় রকম বিড়ম্বনায় রয়েছে, সেহেতু এই সনদ তার অভিন্ন নদীর প্রবাহ নিশ্চিত করতে আইনি সহায়তা প্রদান করতে সহায়ক হবে। ১৯৯৭ সালের এই সনদের ৭.১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিন্ন নদীর পানি অন্য দেশের ক্ষতি করে ব্যবহার করা যাবে না। ৭.২ ধারা বলেছে, তবু যদি ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভাষ্যকাররা বলছেন, এ কনভেনশন কার্যকর হলেই আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে এমন নয়। তবে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য বাংলাদেশকে যে সুকঠিন লড়াই অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হচ্ছে সেই লড়াইয়ে যে সব হাতিয়ার শক্তি যোগাতে পারে নিঃসন্দেহে আলোচ্য কনভেনশন হতে পারে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ যতটা সরব এবং সক্রিয়, আলোচ্য কনভেনশনটি নিয়ে সরকারগুলো রহস্যজনকভাবে সে মাত্রায়ই নীরব এবং নিষ্ক্রিয়। এই বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশকে ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেস’ বা ‘আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন’কে অনুসমর্থন করার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে অব্যাহতভাবে করে আসা হচ্ছে।
সনদের সারকথা
এবিষয়ে গবেষকগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আর্ন্তজাতিক পরিসরে পানি ও পরিবেশ বিষয়ে যে সব বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে এবং সেইসব সমস্যার সমাধানে কিছু আইন-কানুন ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। এসব বিষয়কে বিবেচনায় রেখে পানির আর্ন্তজাতিক ন্যায্য ব্যবহার জাতিসংঘের মূলনীতির আলোকে সমাধান করার লক্ষ্য নিয়ে এ আইনটি তৈরি করা হয়েছে বলে প্রস্তাবনায় দাবি করা হয়েছে। প্রস্তাবনায় পানিপ্রবাহের ন্যায়ানুগ এবং যুক্তিসঙ্গত ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবহার, এইসব ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহ, অন্যের গুরুতর ক্ষতি না করার দায়িত্ব, সহযোগিতামূলক আচরণের সাধারণ নীতিমালা, নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চুক্তির তৃতীয় ভাগে আলোচনা করা হয়েছে, কোনো বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন হলে অপরপক্ষকে জানানো, এইসব পদক্ষেপের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে আগাম সতর্কতা, জবাবদানের সম্ভাব্য সময়সূচী, পদক্ষেপ গ্রহণকারী পক্ষের অন্তর্বর্তীকালীন আচরণ, জবাবদানকারীদের জবাবদান, পক্ষসমূহের মধ্যে পরামর্শ ও মতভেদ হ্রাস, নোটিশ প্রদান না করা হলে সে ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের উপায় এবং জরুরি অবস্থায় পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে সেসব বিষয়। এই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের সংরক্ষণ, রক্ষণ, দুষণ নিয়ন্ত্রণ, দুষণ হ্রাসকরণ, পরিবেশের জন্য ক্ষতিক্ষর কোন নতুন প্রাণী এসব প্রবাহে অন্তুর্ভুক্ত না করানো, সমুদ্র ও উপকূলের পরিবেশ রক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ, পানিপ্রবাহের ব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় স্থাপনা গড়ে তোলার বিষয়সমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও অনুচ্ছেদে ক্ষতিকর পরিস্থিতি হ্রাস কিংবা বন্ধ এবং জরুরি পরিস্থিতি বিষয়ক করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
অনুস্বাক্ষরের এখনি সময়
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন এই কনভেনশনে বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষরের উপযুক্ত সময়। যেহেতু বাংলাদেশে এখন একটি দৃঢ় ঐকমত্যের সরকার ক্ষমতাসীন রয়েছে এবং একটি সর্বজনগ্রাহ্য সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। ফলে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণের মাধ্যমে এই স্বাক্ষর করা যেতে পারে। আর বাংলাদেশের উপর কোনো অনভিপ্রেত বহির্চাপের সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে, তাই এটি উপযুক্ত সময় বলেও বিবেচনা করা যায়।
এবিষয়ে বিশিষ্ট নদী ও পরিবেশ গবেষক ও লেখক হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত কনভেনশন একটি যুগান্তকারী সনদ। এতে বাংলাদেশের মতো নদী ও পানি নিয়ে প্রবলভাবে ভুক্তভোগী একটি দেশের অনুস্বাক্ষর না করে থাকাটা আত্মঘাতী। তার মতে, এখনো একটি প্রভাবশালী মহল প্রতিবেশী দেশটির অনুগ্রহভাজন হয়ে এই অনুস্বাক্ষরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। মাহবুব সিদ্দিকী অবিলম্বে এবিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।