রক্তাক্ত মেহেদিকে ঢাকা মেডিকেল নেওয়া হলে দায়িত্বরত কর্তারা বলেন, উপর থেকে নির্দেশ দিয়েছে চিকিৎসার জন্য কাউকে রিসিভ করা যাবে না। অন্য কোথাও নিয়ে যান, না হয় লাশের সাথে মর্গে ফেলে রাখেন, পরিবার আইস্যা খুঁজে নিয়ে যাবে!। একটু ভাবা যায় কি নির্মম ছিল সে কথাগুলো আর কতটা বর্বর হলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে? এই দৃশ্যের আমি আপনি মুখোমুখি হলে কী করতেন? জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর বিপ্লবের সময় যুদ্ধাহত ও শহীদ হওয়া স্বজন এবং সহযোদ্ধাদের এমনই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। তাদেরই একজন চৌদ্দ বছর বয়সী শহীদ মেহেদি হাসান জুনায়েদ। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বড় হবেন, কুরআনের হাফেজ হবেন। পড়াশোনা শেষে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবেন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই পুলিশের বুলেট কেড়ে নেয় তার জীবন। দুই ভাইবোনের মধ্যে মেহেদি ছিলেন ছোট। রাজধানীর উইল পাওয়ার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন মেহেদি। ৫ আগস্ট ২০২৪ সোমবার ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে যোগ দিতে তার বন্ধুর সঙ্গে চাঁনখারপুলে গিয়ে গুলীবিদ্ধ হন তিনি। তার মাথায় দুইটি গুলী লাগে। দুপুর দেড়টার দিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেদিন মেহেদিকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর শেষবারের মতো নিয়ে যাওয়া হয় তাদের নিজ বাড়িতে। মেহেদির মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে পরিবারটি। ঘরজুড়ে সন্তানের রেখে যাওয়া স্মৃতি আঁকড়ে কেঁদে যাচ্ছেন বাবা-মা এবং তাঁর প্রিয় বোন। পুরান ঢাকার ধুপখোলা পুকুরপাড়ে মেহেদির নিজ বাড়িতে তার ব্যবহৃত সবকিছুই সাজানো-গোছানো, নেই শুধু মেহেদি। সে খেলাধুলা খুব পছন্দ করতো। পরিবারের সবার ছোট হওয়ায় তাকে সবাই ভালোবাসতো। একমাত্র বোন ছিল তার বন্ধু, সারাক্ষণ বোনের সঙ্গে কেটে যেতো গল্পে। মাতিয়ে রাখতো পুরো ঘরটি। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবারটিতে এখানো থামেনি শোকের ছায়া। নীরব হয়ে রয়েছে বাড়িটি।

বাবা-মা’র অভিব্যক্তি: শহীদ মেহেদির মা সোনীয়া জামান বলেন, আমাদের সন্তান ছিল আমাদের রতœ। মেহেদী মেধাবী এবং সাহসী ছিল। ঘটনার দিন সকালে আমার সন্তানকে রসুন ভর্তা দিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলাম। এ সময় মেহেদী বলেছিল এর আগে সে দু’বার আন্দোলনে গিয়েছিল এবং সেখানে খাবারও বিতরণ করেছিল। মেহেদির মা বলেন, ঘটনাস্থলে থাকা মেহেদির এক বন্ধু জানায়- মেহেদি পুলিশের খুব কাছে গিয়ে ঢিল ছুড়ছিল। সে মেহেদিকে ফিরে আসতে বলেছিল, কিন্তু মেহেদি রাজি হয়নি। মেহেদির কোনো দোষ ছিল না। আমি গর্বিত যে আমার ছেলে ন্যায়ের জন্য রাজপথে দাঁড়িয়েছিল। যারা নিহত হয়েছে আমি সবার বিচার চাই।

শহীদ মেহেদির মা কাঁদতে কাঁদতে সোনীয়া জামান বলেন, ওর বাবা বাসা থেকে বের হয় না, একদম নীরব হয়ে গেছে। মেয়েটা ওর বন্ধুকে হারিয়েছে। মেহেদি বাসায় থাকলে সারাক্ষণ আম্মু আম্মু করতো। আমি খুব মিস করছি আমার সন্তানটিকে। মেহেদি ফাস্টফুড আইটেমগুলো খেতে খুব পছন্দ করতো। আমার সন্তান শহীদ হয়ে পরকালের জীবনে চলে যাওয়ার দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে কিন্তু আমার কাছে সবসময় মনে হয় ও ঘরেই আছে। আমি রাতে প্রায়ই ওকে স্বপ্ন দেখি। আমার সন্তানটির এই শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না। দুইটা সন্তানকে কোনোদিন হাত-পা, শরীর কাটতে দেইনি এত যতœ করে বড় করেছি। আমি যখন মেহেদিকে দেখি তখন ওর শরীর রক্তে ভেজা ও মাথায় ব্যান্ডেজ করা ছিল। শুধু আমার সন্তান মৃত্যুর জন্য না, একজন মা হিসেবে আমি শহীদ হওয়া সব সন্তানের বিচার চাই। এরা তো খুব বেশি কিছু চাইছিল না, সামান্য একটা দাবির জন্য শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে হলো। এরা তো আমাদের রতœ ছিল। আমরা মায়েরা গর্বিত যে এমন শহীদ সন্তানদের জন্ম দিয়েছি।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, আড়াই মাস ধরে ঠিক মতো ঘুমাতে পারি না। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যাই। রাতে ঘুম ভেঙে যায়, ছেলের কথা মনে পড়ে। কাঁদতে থাকি। তার প্রিয় খাবার রসুনভর্তা তৈরি করে রাখি, কিন্তু আমার মোস্তাকিম (মেহেদি) খেতে আসে না। তার বিড়ালগুলো তাকে খুব মিস করে। তার রুমে ঘুরাঘুরি করে। তার ছবির পোস্টারের ওপর শুয়ে থাকে, তাকে খোঁজে। সুকেইস-ভর্তি ক্রেস্টগুলো দেখি। কানে বাজে তার কথা, আম্মু দেখবা, আমাকে নিয়ে তোমরা একদিন অনেক গর্ববোধ করবা।

মায়ের বর্ণনায় সন্তানের শহীদ হওয়ার ঘটনার দিন : ৫ আগস্ট ২০২৪ সোমবার ভোরে শহীদ মেহেদির মা সোনীয়া জামান ফজর নামায পড়ে কুরআন শরীফ পড়তেছেন। তিনি শুনতে পান ড্রয়িংরুম থেকে টিভির শব্দ শোনা যাচ্ছে। উনি গিয়ে দেখেন, মেহেদি বিভিন্ন চ্যানেল পাল্টিয়ে খবর দেখতেছে। মা বলেন, এতো ভোরে টিভি না দেখে ঘুমাও কিছুক্ষণ, বাবা। মেহেদি মাকে বলে, ঘুমাবো না, আম্মু। মা তখন বলেন, কিছু খাবে? রেডি করে দিবো? মেহেদি মাথা নাড়িয়ে না-বোধক উত্তর দেয়। মেহেদির আম্মু বলে রোজা রাখছি, কিছুক্ষণ ঘুমাই এ কথা বলে মা তখন ঘুমাতে চলে যায়। মেহেদির বাবা তখন ফজর পড়ে হাঁটতে বের হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরে বাবা মেহেদিকে বলেন, যাও বাইরে (দোকান) থেকে নাস্তা নিয়ে আসো। মেহেদি বলে, আজকে সকালে নাস্তা করব না। মা’র হাতে রসুনভর্তা দিয়ে ভাত খাব। মা বলে, শুধু রসুনভর্তা? সাথে ডিম ভেজে দিই? (তার মায়ের হাতে রসুনভর্তা তার খুব পছন্দের ছিল)। মায়ের হাতে ভাত খেতে খেতে মেহেদি বলে, আম্মু তোমার কাছে একটা বিষয় লুকাইছি। মা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়, কী লুকাইছো! মেহেদি হাসতে হাসতে বলে, আমি তোমাকে না জানিয়ে লুকিয়ে ২দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গেছি। রাস্তায় ভাইয়াদের পানি-বিস্কুট খাওয়াইছি।

শহীদ মেহেদির সকালের নাস্তা খেতে খেতে মাকে বুঝায়, আমাদের বয়সী কতজন রাস্তায় নামছে। মার খাচ্ছে। প্রতিবন্ধী ছেলেরা পর্যন্ত রাস্তায় নামতেছে, আমরা কিভাবে ঘরে বসে থাকি। বড় ভাইয়ারা তো আমাদের সবার অধিকারের জন্যই জীবন দিচ্ছে। ছেলের কথায় মন গলে মায়ের। মা তখন বলেন, আজকে আমরা সবাই বের হবো। মেহেদির বড়বোন, মা এবং মেহেদি একসাথে বের হওয়ার পরিকল্পনা করেন। মেহেদির বড়বোনের কলেজ থেকে জানতে পারে সেখানে স্টুডেন্টরা অভিভাবকদেরও আহ্বান করছে যেতে। তারা পরিকল্পনা করে সেখানে যাবেন। এরমধ্যে মা বোরকা পরছেন, মেহেদি বলে মা একটু অপেক্ষা করো, আমার এক বন্ধু আছে ওকে নিয়ে আসি। আমরা একসাথে যাব। মা বলেন, ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আইসো। এইদিকে মেহেদির মা-বোন যখন রেডি হচ্ছিল বের হতে তখন ওর বাবা বকাঝকা করতে থাকে। আজকে ঢাকার পরিস্থিতি ভালো হবে না। তোরা ভুলেও বের হইছ না। মেহেদির মা বোরকা পরতে পরতে বলে, আল্লাহ কপালে যা রাখছে তা-ই হবে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা মার খাবে, আমরা ঘরে বসে থাকব কিভাবে! এরমধ্যে মা-মেয়ে রেডি হয়ে মেহেদির জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু মেহেদির ফেরার কোনো লক্ষণ নাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মা বলে, আচ্ছা থাক, ও মনে হয় বন্ধুকে আনতে গিয়ে খেলতে চলে গেছে (প্রতিদিন এ সময় বন্ধুদের সাথে ধুপখোলা মাঠে খেলতে যায়)। আমরা দু'জন বের হয়ে যাই। মা-মেয়ে চলে যায় মেয়ের কলেজ মতিঝিল আইডিয়ালের সামনে।

এদিকে আনাস বন্ধুরে সাথে নিয়ে শহীদ মেহেদি হাসান জুনায়েদ চলে যায় চাঁনখারপুল আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ জিজ্ঞেস করতেছিল, কই যাচ্ছেন? মেহেদির মা প্রতিবারই উত্তর দিছেন, লাশ দেখতে যাচ্ছি। আমার নিকটাত্মীয় একজনের লাশ। তিনি তখনো জানতেন না, তাকে ঘরে ফিরতে হবে ছেলের লাশের খবর পেয়ে। ঘরে ফিরে তাকে সত্যিই লাশ দেখতে হবে। মেয়েকে নিয়ে বারোটার আগেই আইডিয়াল কলেজের সামনে পৌঁছে যান। উনাকে দেখে, একজন শিক্ষার্থী মাইকে বলতেছিল, আমাদের একজন মা চলে এসেছেন মেয়েকে সাথে নিয়ে। এভাবে আমাদের সব মায়েরা আমাদের সাথে থাকলে আমরা সাহস পাব। ...এরমধ্যে প্রায় এক-দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেছে। মায়ের মনটা কেমন যেন ছটফট করতেছে। পাশে থাকা মেয়ে বলে, আম্মু তুমি রোজা রাখছো, আর রোদ তো এজন্য খারাপ লাগছে। দেখবা ঠিক হয়ে যাবে। উনি তখন উত্তর দেন, না রে। আমার বুকটা ধুকধুক করছে। ভালো লাগতেছে না। এটা রোজা রাখার জন্য না। আমার মেহেদির কিছু হলো কিনা, আল্লাহ মাবুদ জানে। এরমধ্যে মেয়েকে একটু বকাও দেন, তোমার ফোনে ২টা সিম, একটা সিম তো ওর ফোনে রাখলে এখন খোঁজ-খবর নিতে পারতাম। মেয়ে তখন বলেন, ওর ফোনে সিম রেখে কী হবে, মাঝেমধ্যে একটু গেমস খেলা ছাড়া ওই ত কারো সাথে কথাবার্তা বলে না। আন্দোলনেই তাদের সময় কাটে। কিছুক্ষণ পর ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখেন প্রায় ১৫-১৬টা কল। সব তার বাপের বাড়ির আত্মীয়স্বজনের কল। মেহেদির মা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে বড় ভাইয়ের কল রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে বলে ওঠে, মোস্তাকিম কই? (এখানে বলে রাখি, মেহেদির ডাকনাম মোস্তাকিম। তার মা আদর করে এ নাম দিয়েছিল। এটা তার সার্টিফিকেট নামে নাই।) উত্তর দেন, বাসায়। তুই শিউর, ও বাসায় আছে? এ সময় তো ঘরেই থাকে। তাড়াতাড়ি ওর খোঁজ নে। এভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে কল আসতে থাকে মেহেদির মায়ের কাছে। কেউ তখনো বলেনি সে মারা গেছে। বলছে, মাথায় আঘাত পেয়েছে, তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে। ততক্ষণে মায়ের মনের ভেতর পুরোপুরিভাবে খবর হয়ে গেল তার কলিজার টুকরার কিছু একটা হয়ে গেছে। মেয়েকে নিয়ে আইডিয়াল কলেজের আন্দোলন থেকে দ্রুত বাসায় ফিরেন। বাসার কাছাকাছি এসে দেখেন, তাদের বাসার সামনে পুকুরপাড়ে শতশত মানুষ, কেউ কান্নাকাটি করতেছে। উনি সবাইকে ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখেন, তার ছেলের নিথর দেহটা পড়ে আছে। ঐ মুহূর্তে তার সারা শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। সেন্সলেস হয়ে পরেন।

চাঁনখারপুলে বন্ধুদের সাথে আন্দোলন করে করে শহীদ হয়েছিল শেখ মেহেদি হাসান জুনায়েদ: ৫ আগস্ট ২০২৪ সোমবার এগারোটার দিকে মেহেদি তার বন্ধুদের সাথে চাঁনখারপুল আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনে চলে যায়। দেড়-দুই ঘন্টা সেখানে পুলিশের সাথে তারা ফাইট করে। পুলিশের গুলীর বিপরীতে প্রতিরোধ হামলা চলে ইটপাটকেল ছুঁড়ে। মেহেদি এবং তার বন্ধুরা ছিল বড়দের সাথে একদম সামনে। একটার দিকে তার এক বন্ধু বলে, দোস্ত চল আমরা বাসায় চলে যাই। মেহেদি উত্তর দেয়, তুই যাইলে যা, আমি যাব না। হয় শহীদ হয়ে ঘরে ফিরব, না হয় তার পতন (ফ্যাসিস্ট হাসিনার) শেষে বীরের বেশে ঘরে ফিরব। মেহেদির এক বন্ধু তখন বাসায় চলে যায়, আরেক বন্ধু তার সাথে থেকে যায়। আনুমানিক দেড়টার দিকে, ওদের মিছিল যখন একটু সামনে আগায় তখন ব্যাকফুটে যায় সামনের পুলিশের দল। তখন পাশে একটা গলির মুখে অবস্থান করছিল কিছু পুলিশ। মেহেদি মাথানিচু করে ইটের টুকরা হাতে নিতে যাবে, ঠিক তখনি পরপর দুইটা গুলী তার মাথায় আঘাত করে। একটা গুলী একপাশে দিয়ে ঢুকে ছিদ্র করে আরেকপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। আরেকটা গুলী তার চোখ দিয়ে ঢুকে ভেতরে আটকে যায়। আহত অথবা নিহত মেহেদিকে মানুষজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায়। মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তাকে রিসিভ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বলে দেয়, উপর থেকে নির্দেশ এসেছে কাউকে চিকিৎসা না দিতে। এখান থেকে নিয়ে যান, না হয় মর্গে নিয়ে লাশের সাথে ফালাই রাখেন। পরিবার আইস্যা খুঁজে নিয়ে যাবে। পরে সেখান থেকে মেহেদিকে মিটফোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সে আর বেঁচে রইল না। শহীদের খাতায় তার নাম যোগ হয়ে যায়। ঐখানের তার বন্ধুরা মেহেদির পকেটে থাকা সিম ছাড়া স্মার্টফোনটাতে ডায়াল কলে দেখেন, বাবা নামে একটা নম্বর সেইভ করা। মানুষজন মনে করছিল, বোধহয় তার বাবা হতে পারে। কিন্তু কল দিলে তার নানা ধরেন। মেহেদির মা তার বাবার (মানে মেহেদির নানা) নম্বর বাবা নামে সেইভ করছিল। এই ফোনটা তার মা চালাতো। তাদেরকে কল দিয়ে মেহেদির খবর জানানো হয়। সেখান থেকে আত্মীয়স্বজন সবার জানাজানি হয়। তার মা তখনো মেয়েকে নিয়ে আডিয়ালের সামনে রাজপথে আন্দোলনে। মেহেদির নিথর দেহ বাসায় আনার এক ঘন্টা পর তিনি বাসায় এসে পৌঁছান।

শহীদ মেহেদির মা কাঁদতে কাঁদতে সোনীয়া জামান বলেন, অন্যদিন ঘুম থেকে দেরি করে উঠলেও ওইদিন সোমবার (৫ আগস্ট ২০২৪) সকাল ৬টার সময় ঘুম থেকে উঠে যায় মেহেদি। এ সময় শুয়ে শুয়ে আন্দোলনের ভিডিওগুলো দেখে। ঘটনার দিন মানে মেহেদির শহীদ হওয়ার দিন সোয়া দুইটার দিকে হঠাৎ আমার বড় ভাই কল দিয়ে বলে তুমি কই। এ সময় বলে মেহেদি কই? গুলীর ঘটনাটি শুনতে পায়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় গুলী লাগার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় মেহেদি। যারা হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং আশপাশে যারা ছিল তারাও বলেছে একই কথা। খবর শুনে আমি একটা রিকশা নিয়ে বাসার দিকে চলে আসি। বাসায় এসে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমার সন্তান আর নেই। ভেবেছিলাম হয়তো কোনো আঘাত লেগেছে কিন্তু এসে দেখি আমার মেহেদীর রক্তাক্ত নিথর দেহ রেখে দিয়েছে বাড়ির সামনে। আমার একমাত্র ছেলে ছিল মেহেদি। কীভাবে আমার মনটাকে সান্ত¡না দিয়ে রাখবো।

শহীদ মেহেদির যতগুণ: মেহেদির বয়স মাত্র ১৪বছর। উইল ফাওয়ার স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে, একইসাথে কুরআনে হাফেজ হবে। এজন্য হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তিও হয়েছিল। প্রায় ১০ পারার মতো মুখস্থ করে ফেলছে। নম্র এবং ভদ্র ছেলে হিসেবে এলাকার সবাই তাকে ভালোবাসত। তার মা জানায়, মেহেদির জানাযায় এতো মানুষ হয়েছে যে, এখানে কেন্দ্রীয় ঈদের জামাতেও এতো মানুষ হয়নি কখনো। কয়েক মাস আগে এলাকার মসজিদে আয়োজন করছিল, যারা ৪০দিন জামাতে ৫ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে, তাদের সাইকেল দেওয়া হবে। মেহেদি সেখান থেকে অনেক বড় একটা সাইকেল পেয়েছিল। ওর মা বলছিল, এতবড় সাইকেল তুমি কী করবে? ও তখন বলে, কয়দিন পর আমি পড়তে চলে গেলে আব্বু চালাবে আমার সাইকেল।

কোনো কারণে বাবা তাকে মাঝেমধ্যে বকাঝকা করলে বাবার অনুপস্থিতিতে মাকে সে সময় বলতো, দেখ আম্মু, আব্বু এখন আমাদের বকাঝকা করে। একদিন দেখবা আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে তোমরা গর্ববোধ করবা। মা তাকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, তোমার আপু ভালো ছাত্রী। এসএসসিতে গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছে, ওকে নিয়ে নাহয় আশা করা যায় ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে, কিন্তু তুমি এমন কী করছো বা করবা যে তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করবো! মেহেদি তখন বলে ওঠে, আরে দেইখো, এখন নাহয় কিছু করতে পারি নাই। একদিন দেখবা আমাকে নিয়েই বেশি গর্ববোধ করবা। মেহেদি সত্যিই বাবা-মাকে গর্ববোধ করতে পেরেছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মিত হয়েছে তার রক্তের উপর দিয়ে। তার মা-বাবার জন্য এটা পরম গৌরবের। এছাড়াও ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক আন্দোলনে শহীদ মেহেদী হাসান জুনায়েদ এর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। জুনায়েদ ৫ আগস্ট চাঁনখারপুল প্রাণ হারান। জুনায়েদের পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা করাসহ তাদের পাশে থাকার কথা জানান ইশরাক হোসেন।