রাজধানী
উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরও সীমান্তে একে একে চার বাংলাদেশী হত্যা
বিজিবি-বিএসএফ শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরও থেমে নেই বিএসএফ। ভারতের নয়াদিল্লীতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের চার দিনব্যাপী সম্মেলন ১৭-২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।
Printed Edition
বিজিবি-বিএসএফ শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরও থেমে নেই বিএসএফ। ভারতের নয়াদিল্লীতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের চার দিনব্যাপী সম্মেলন ১৭-২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বাংলাদেশী নাগরিকদের সীমান্তে হত্যার ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বিজিবির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি জোর আহ্বান জানানো হয়। বিএসএফ এতে সম্মতি জানানোর মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই সীমান্তে চার বাংলাদেশীকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন ভারত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে এবং একজন নিহত হয় খাসিয়াদের গুলীতে।
সর্বশেষ গতকাল শনিবার পঞ্চগড়ের ভিতরগড় সীমান্তে বিএসএফের গুলীতে আল আমিন (৩৬) নামে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়েছেন। ভোরে জেলার সদর উপজেলার কাজীরহাটের উত্তর তালমা এলাকায় ভারতের অভ্যন্তরে রাজগঞ্জের খালপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত আল আমিন পঞ্চগড় সদর উপজেলার হারিভাষা ইউনিয়নের জিন্নাতপাড়া গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, আল আমিন ৩ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। শুক্রবার রাতে তিনিসহ ১৫ থেকে ২০ জনের একটি চোরাকারবারি দল ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার করছিল। এ সময় বিএসএফ তাদের বাধা দিলে চোরাকারবারিদের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে বিএসএফ-এর গুলীতে ঘটনাস্থলেই আল আমিন নিহত হন। তার লাশ বিএসএফ নিয়ে গেছে। বিষয়টি জানার পর সকালে নীলফামারী ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ মো. বদরুদ্দোজা সীমান্ত পিলার ৭৪৪/৭-এস এলাকায় ভারতের ৪৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের সঙ্গে পতাকা বৈঠক করেন। বৈঠকে এ ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে লাশ ফেরতের আহ্বান জানান। স্থানীয়রা জানান, আল আমিন ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামে থেকে কৃষি কাজ করতো। মাত্র ছয় মাস আগে বিয়ে করেছিলো। তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। কসবা থানার সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম জানান, তাদের বাড়ি সীমান্তের একদম কাছে হওয়ায় সেখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও নেই। ঘটনার পর এখনো কোনো মামলা হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, গত ১১ বছরে সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ৩৪৫ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। ২০১৪ সালে ৩২ জন, ২০১৫ সালে ৪৬ জন, ২০১৬ সালে ৩১ জন, ২০১৭ সালে ২৪, ২০১৮ সালে ১৫, ২০১৯ সালে ৪৩, ২০২০ সালে ৪৯, ২০২১ সালে ১৮, ২০২২ সালে ২৩, ২০২৩ সালে ৩১, ২০২৪ সালে ৩০ জন নিহত হন। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুইজন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে একজন নিহত হয়েছেন।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেছেন, এখন আমাদের এই বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া উচিত। বিএসএফ বার বার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী এই দুই দেশের মানুষের মধ্যে নানা ধরনের যোগাযোগ আছে। তারা চোরাচালানের কথা বলে। সেটা সত্য ধরে নিলেও চোরাচালানের শাস্তি তো গুলী করে হত্যা নয়। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত আছে। সেখানে তো তারা এভাবে হত্যা করে না। আর ভারতের ভিতর থেকেইতো গরু আসে। সেই গরু কেন আটকানো হয় না। আসলে এই হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায়। আতঙ্কে রাখতে চায়।
সম্প্রতি বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, সীমান্ত হত্যা কোনোভাবে কাম্য নয়। ভারতীয় নাগরিকরা সীমান্ত আইন না মানলে কঠোর হবে বিজিবি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বাংলাদেশে ভারতীয় অনুপ্রবেশ যারা করে তাদের প্রতি সুন্দরভাবে নিয়মের মধ্যে গ্রেপ্তার করে হস্তান্তর করি আমরা। ভবিষ্যতে সেটা কতটুকু আর করা যাবে? সম্প্রতি ভারতের নয়াদিল্লীতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনার বিষয়টি প্রাধান্য এক নম্বরে ছিল সীমান্ত সম্মেলনে।
বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল: গত ২১ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লীতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলনে বাংলাদেশী নাগরিকদের সীমান্ত হত্যার ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি জোর আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে যে কোনো স্থায়ী স্থাপনা এবং কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ক্ষেত্রে যৌথ পরিদর্শন ও যৌথ আলোচনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। তিনি জানান, সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে। অপরদিকে বিএসএফ মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের নিহতের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সীমান্ত হত্যার ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি জোর আহ্বান জানান। সম্মেলনে আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম সীমান্তের শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়টি তুলে ধরেন বিজিবি মহাপরিচালক। সীমান্তে ভবিষ্যতে এ ধরনের পুনরাবৃত্তি রোধ করার বিষয়ে বিজিবি মহাপরিচালক বিএসএফ মহাপরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
দুই সপ্তাহে সীমান্তে চার বাংলাদেশী নিহত
খাসিয়ার গুলীতে বাংলাদেশী নিহত: সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়ার গুলীতে শাহেদ মিয়া (২৫) নামে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়। শুক্রবার (৭ মার্চ) ভোরে উপজেলার ১ হাজার ৩১৯ পিলার সংলগ্ন লাইজুড়ি বাসকোনা এলাকায় ভারতে প্রবেশ করেন শাহেদসহ কয়েকজন। এ সময় খাসিয়াদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে খাসিয়ারা গুলী করে। এতে ঘটনাস্থলেই শাহেদের মৃত্যু হয়। সকালে বিএসএফ লাশ নিয়ে যায়। সিলেটের কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আউয়াল জানান, শাহেদ নামে এক যুবককে খাসিয়ারা গুলী করে হত্যা করেছে। ঘটনার পর বিএসএফ লাশ নিয়ে গেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে মরদেহ ফেরত আনার চেষ্টা চলছে।
বিএসএফের গুলীতে বাংলাদেশী নিহত: ত্রিপুরায় সিপাহীজলার সোনামুড়া সাব ডিভিশনের পুটিয়াতে বিএসএফের গুলীতে এক বাংলাদেশী নিহত হয়। বিএসএফের দাবি, নিহত ব্যক্তি চোরাকারবারী। একাধিক স্থানীয় ব্যক্তির দাবি, তিনি গরু খুঁজতে এসেছিলেন। তবে পুলিশ এমন দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান। ঘটনাটি ঘটেছে ২৮ ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যা সাতটার কিছুটা পরে। পুটিয়াতে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ গুলীর শব্দে কেঁপে ওঠে পুটিয়া সীমান্তের ৬ ও ৭ নম্বর গেট এলাকা। গ্রামবাসীরা আতঙ্কে বাড়ি থেকে বের হননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে এক বাংলাদেশী যুবক আহত হয়েছেন, তাকে বিশালগড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একজন আহত বিএসএফ জওয়ানকেও ওই একই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে চিকিৎসা শুরু করা হলেও ওই বাংলাদেশী যুবককে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
কসবা সীমান্তে বাংলাদেশী যুবককে গুলী: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের পুটিয়া গ্রাম সংলগ্ন সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সামিউল ইসলাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বরাত দিয়ে জানান, নিহত যুবকের নাম আল-আমিন (৩২)। তিনি দক্ষিণ পুটিয়া গ্রামের সুলতান মিয়ার ছেলে। ইউএনও জানান, রাতে আল-আমিনকে পুটিয়া সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। বিএসএফ তাকে চোরাচালানকারী সন্দেহে গুলী চালায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে বিএসএফ সদস্যরা তাকে ভারতের বিশালগড় মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতেই তিনি মারা যান।