মিয়া হোসেন : রমযানের প্রথম ভাগের দশ দিন রহমতের। আর আমরা এখন এ রহমতের সময় অতিবাহিত করছি। আজ পবিত্র রমযানের দ্বিতীয় দিন। ইবাদত বন্দেগী আর বিশেষ আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে রহমত প্রাপ্তির অফুরন্ত সুযোগ এখনই। সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই আল্লাহর রহমত লাভ করতে হবে।

মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র রমযান সম্পর্কে শুভ সংবাদ দিয়েছেন, ‘রোজাদার যে কোনো শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন, সে আল্লাহর রহমত বরকত ও মাগফিরাত হতে কোনক্রমেই বঞ্চিত হবে না। রোজা আমারই জন্য এবং আমিই এর প্রতিফল প্রদান করবো। আল্লাহর এ ঘোষণায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রাপ্তি, জানা অজানা গোনাহ থেকে ক্ষমা লাভ এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের মাস মাহে রমযান। প্রকৃতপক্ষে পবিত্র রমযান মাস মনের আর্দ্রতালাভ, কোমলান্তকরণ, বিনয় ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভাবধারায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট মওসুম। এ সময়ে রোজাদারের মধ্যে আধ্যাত্নিক ও দৈহিক ভাবধারা জাগ্রত হয়। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভের দিকে ধাবিত হয়। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ লাভ করে মুক্তি ও নিষ্কৃতি প্রাপ্তদের মাঝে নিজেদের আসন প্রতিষ্ঠিত করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের একান্ত কাম্য হওয়া খুবই বাঞ্ছনীয়।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, মাহে রমযানে সিয়াম সাধনার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হল না সে প্রকৃতপক্ষেই দুর্ভাগা।’ এ দুর্ভাগ্যের বোঝা মাথায় নিয়ে যারা নিজেদের জীবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিতে চায় তাদেরকে আজ এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে, সকলেরই মহান আল্লাহ পাকের নিকটে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ সীমাহীন যাত্রাপথের সম্বল সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জন করে নেয়াই শ্রেয়। জ্ঞান ও বিবেক সম্পন্ন মানুষ ন্যায় কল্যাণ এবং মঙ্গলময় জীবন যাপনেই আনন্দ পায়, শান্তি পায়। এ শান্তিই হোক সকলের কামনার ধন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, রমযানের প্রথম দশদিন আল্লাহর রহমত নাজিলের, দ্বিতীয় দশদিন গোনাহ মাফ তথা মাগফিরাতের এবং তৃতীয় দশদিন আল্লাহর আজাব থেকে নাজাতের জন্য নির্ধারিত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত মুসলিম শরীফের এক হাদিসে বলা হয়েছে, যারা রমযানের চাঁদের প্রথম তারিখ থেকে শেষ দিন পর্যন্ত রোযা রেখেছে তারা সে দিনের মতই নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদেরকে নিষ্পাপরূপে জন্ম দিয়েছিলেন। অর্থাৎ মাতৃগর্ভ থেকে মানুষ যেভাবে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয় রমযানের ত্রিশ দিন রোজা পালন করলে সে তেমন নিষ্কলুষ হয়ে যাবে।

পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ মাহে রমযানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিবৃত করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, এটা এমন এক মাস যে প্রথম দশ দিন রহমতের বারিধারায় পরিপূর্ণ। মাঝের দশ দিন ক্ষমা ও মার্জনা লাভের জন্য নির্ধারিত এবং শেষ দশদিন জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভের উপায়রূপে নির্দিষ্ট। রোজাদারদের মাঝে এমন এক শ্রেণির লোক আছেন যারা তাকওয়া ও পরহেজগারী সম্পন্ন এবং পাপ ও বর্জনীয় কাজকর্ম হতে বেঁচে থাকার জন্য সর্বদাই যত্নবান। তারা সিয়াম সাধনার মাঝে কোন ভুলত্রুটি হয়ে গেলে চেতনা হওয়ার সাথে সাথেই তওবা ও এস্তেগফার করে নিজেদেরকে সংশোধন ও ত্রুটিমুক্ত করে নেন, এ শ্রেণির রোজাদারদের প্রতি রমযান মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই রহমতের বারী বর্ষণ হতে থাকে। তারা যখন রোজার প্রথম দশ দিন একান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে অতিবাহিত করেন, তখন তারা আর সেই লোক থাকেন না। যেমনটি রোজা শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ছিলেন। বরং তাদের মাঝে মুমিন সুলভ মহৎ গুণাবলী আগের তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে যায়।

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন : যে লোক রমযান মাসে রোজা রাখবে ঈমান ও চেতনা সহকারে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, যে লোক একটি দিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তার মুখমন্ডল জাহান্নাম হতে সত্তর বছর দূরে সরিয়ে রাখবেন। (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত নবী কারীম (সা.) বলেন, জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি বিশেষ দরজা রয়েছে। সে দরজা দিয়ে শুধুই রোজাদাররাই প্রবেশ করবে।

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : তোমাদের নিকট রমযান মাস সমুপস্থিত। তা এক অত্যন্ত বরকতময় মাস। আল্লাহ এ মাসে তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় শয়তানগুলো আকট করে রাখা হয়। এ মাসে একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে লোক এ মাসে তার মহাকল্যাণ লাভ হতে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যিই হতভাগা। (নাসাঈ ও বায়হাকী)

রোযার প্রথম কাজ হচ্ছে বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুদৃঢ় ইচ্ছা। নিয়ত চেতনা ও অনুভূতি সৃষ্টি এবং একে কার্যকর করার কাজ করে। চেতনা সৃষ্টি হলে ইচ্ছা জাগে। আর ইচ্ছা চেষ্টা-সাধনার যোগ্যতা সৃষ্টি করে। কোনো কাজের জন্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক চেতনা এবং সাফল্যের জন্য দৃঢ় ইচ্ছা শরীরের জন্য প্রাণ সমতুল্য। এ অর্থে নামায, রোযা এবং ইবাদাতের জন্য নিয়তের তাগিদ করা হয়েছে। কোনো কোনো আলেমের দৃষ্টিতে মুখে নিয়ত উচ্চারণ ছাড়া আমল শুদ্ধ হয় না। আবার কারো কারো দৃষ্টিতে অন্তরের সিদ্ধান্ত এবং মনের ইচ্ছাই যথেষ্ট। শুধুমাত্র নিয়তের উচ্চারণ আওড়ানো অথবা মনের মধ্যে কোনো ফরয কাজ আদায় করার ইচ্ছা পোষণ করার মাধ্যমে ফেকাহ ও আইনের শর্ততো অবশ্যই পূরণ করা যায়। কিন্তু নিয়ত এভাবে প্রাণের সঞ্চার করে যখন এ নিয়ত চেতনায় কাজের উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্ট করে দেয়, অন্তরে উদ্দেশ্য লাভের জন্য দৃঢ় ইচ্ছা জাগ্রত করে।

জীবন্ত ও মৃত দেহের মধ্যে দেখতে খুব একটা পার্থক্য নেই। জীবন্ত দেহ শক্তি প্রয়োগ, নড়াচড়া ও কাজের যোগ্যতা রাখে। পক্ষান্তরে মৃতদেহ শক্তি প্রয়োগ, নড়াচড়া ও কাজের যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত। আমলসমূহের একই অবস্থা। যদি আমলের মধ্যে শুদ্ধ নিয়তের প্রাণ থাকে তাহলে তা অত্যন্ত ভালো, ফলোদায়ক। একথাটিকেই নবী করীম স. এভাবে বলেছেন: কাজের ভালো-মন্দ এবং গুরুত্বের মাত্রা নিয়তের উপর নির্ভরশীল"-বুখারী। প্রতিটি মানুষের কর্মফল সে তার নিয়ত অনুযায়ী পাবে।

নিয়ত বিশুদ্ধ এবং আন্তরিক হতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি কাজ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এবং শুধুমাত্র তার কাছ থেকেই বিনিময় পাওয়ার জন্য করতে হবে। যদি নিয়ত বিশুদ্ধ ও আন্তরিক না হয়, আর যদি কাজটি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য না করা হয়, তা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না এবং পরিশ্রমের ফলাফল নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

নিয়ত আকাক্সক্ষা ও চাওয়ার প্রকাশ। নিয়ত আকাক্সক্ষা ও চাওয়ার স্রষ্টা, আকাক্সক্ষা ও চাওয়া থাকলে দৃঢ় ইচ্ছা ও সাহস সৃষ্টি হয়। দৃঢ় ইচ্ছা ও সাহসই সেই শক্তি যার মাধ্যমে আমাদের শরীরকে সচল রাখে। এটা সেই মৌলিক গুণ, যা ছাড়া কোনো পথই অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এমনকি পবিত্র রমযান মাসের সফরও আমাদেরকে লক্ষ্য পানে পৌঁছাতে পারবে না।

পবিত্র রমযান মাসকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে নিজেদের অবস্থান, এর বাণী, এর উদ্দেশ্য এবং এর মহত্ব বরকতের চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। সাথে সাথে এই নিয়ত করতে হবে যে, এ মাসে নিজেদের যে কর্মতৎপরতা ও ইবাদাতের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে, সেগুলোর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে সেই তাকওয়া অর্জন করার চেষ্টা করতে হবে, যা কিনা আপনাদেরকে আল্লাহর দীনের চাহিদা এবং কুরআন মাজীদের মিশন পূর্ণ করার যোগ্য করে গড়ে তুলবে। এছাড়া এ মাসের পরিপূর্ণ কল্যাণ অর্জন করার জন্য কঠিন পরিশ্রম ও দৃঢ়তার সাথে ফরয, সুন্নত ও নফল কাজগুলো সুন্দরভাবে আদায় করার চেষ্টা করতে হবে।

রমযান মাস আগমনের পূর্ববর্তী মাসের শেষ দিন অথবা রমযান মাসের প্রথম রাতেই এ মাসটিকে পূর্ণাঙ্গভাবে লাভজনক করার উদ্দেশ্যে রাতে কিছুক্ষণ সময় নিরিবিলি বসতে হবে। আল্লাহর দরবারে নিজেকে উপস্থিত মনে করতে হবে, তাঁর প্রশংসা করতে হবে, নবী স.-এর প্রতি দরূদ পাঠ করতে হবে, নিজের গুনাহসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, অতঃপর পুরো মাসের জন্য চেষ্টা-সাধনা এবং পরিশ্রম করার নিয়ত করতে হবে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, আল্লাহর নিকট সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করতে হবে এবং প্রার্থনা করতে হবে যেন তিনি নিজে আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।