আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে আ’ লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
ওই সময়েই নানামুখী যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। ২০০১ সালে আ’লীগ বিরোধী দলে গেলে তিনি বিরোধীদলীয় নেতার প্রটোকল কর্মকর্তা হন। পরবর্তী সময়ে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ফেনী আ’লীগকে পুনর্গঠনের মূল কারিগর ছিলেন এ নাসিম।
শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসারের পদটাই তার জীবনে আলাদিনের চেরাগ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো পদপদবি না থাকার পরও তার হাতে টাকা আসতে থাকে স্রোতের মতো। প্রশাসনের বদলি, পদায়ন থেকে শুরু বিনা টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দেয়া, বিদ্যুৎ কোম্পানরি লাইসেন্স করে দেওয়া কাজ করে কামিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।
এর বাইরে হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। শেখ রেহানার অবৈধ টাকার সংগ্রাহকও বলা হতো নাসিমকে। আর এই অবৈধ টাকার জোরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাগিয়ে নেন ফেনী-১ আসনের নমিনেশন। বনে যান বিনা ভোটের এমপি।
এরপর শেখ হাসিনার ঘনিষ্টজন হওয়ায় বিনা পূঁজিতে ব্যবসায়িক পার্টনার হয়ে শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লোন নিয়ে বিদেশে পাচার করেছিলেন ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক নাসিম।
জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এস আলমের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার ওয়ান লিমিটেডের মালিকানায়ও নাসিম রয়েছেন। প্রতিমাসে ব্যাংকে এসএস পাওয়ার থেকে মোটা অংকের চেক নাসিমের এবং তার স্ত্রী প্রফেসর ডা. জাহানারা আরজু এর নামে জমা হতো।
অভিযোগ আছে,তাকে ২০ পার্সেন্ট কমিশন না দিলে কোনো টেন্ডারই পেতো না ব্যবসায়ীরা। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই তিনি বুঝে নিতেন তার কমিশনের টাকা। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির কারণে অনেকেই ধরা পড়লেও সব সময় অন্তরালে থেকে যেতেন নাসিম।
বিগত জুলাই-আগস্টে বৈষাম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ফেনীর মহিপালে তার যোগসাজশে গুলী করে ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। তবুও দৃশ্যমান কোনো অ্যাকশন নেই তার বিরুদ্ধে।
এর আগে প্রায় সময়ই দম্ভ করে বলতেন, হাসিনা সরকারের আমলে কেউ তার কিছু করতে পারবে না। কারণ তার নিয়োগ দেওয়া অনেকেই তখন আওয়ামী সরকারের ভালো পজিশনে ছিলেন। অথচ, হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র করে চলছে নাসিম। দেশ থেকে পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে ভারতের ভূইফোড় মিডিয়ার গুজব প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের সামনে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছেন তিনি।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, তার টাকায়ই পরিচালিত হচ্ছে আ’লীগের গুজব সেল। কারণ, হাসিনা-রেহানার একসময়ের ফান্ড ম্যানেজার নাসিম ছিলেন তাদের দুই বোনের চোরাই টাকার জিম্মাদার। আর সেই অর্থ ব্যয় করছে ড. ইউনূস সরকারকে ব্যর্থ করার মিশনে।
এছাড়া ফেনীর পতিত গডফাদার নিজাম হাজারী তাকে অভিভাবক বলে সম্বোধন করতেন। তার কারণ নাসিম দলীয় সমর্থন দিয়ে ২০১১ সালে ফেনী পৌরসভার নির্বাচনে অস্ত্র মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী নিজাম উদ্দিন হাজারীকে মেয়র নির্বাচিত করান। পরের বছর নিজাম হাজারীকে জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক করার পেছনেও ছিলেন নাসিম। প্রশাসনিক খরচের কথা বলে ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনে ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ফেনীর তিনটি আসনের প্রার্থীদের কাছ থেকে নাসিম বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ওইসময় ফেনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাসিমকে প্রধান অতিথি করা হতো। পোস্টার-ব্যানারে লেখা থাকত ‘ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের অভিভাবক আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম’। নিজাম হাজারীসহ এসব অনুষ্ঠানের বক্তারাও আলাউদ্দিন নাসিমকে ‘অভিভাবক’ হিসেবে সম্বোধন করতেন।
নাসিমের বাড়ি জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা পরশুরামের গুথুমা গ্রামে। বিলোনিয়া স্থলবন্দরটির অবস্থানও ওই উপজেলায়। সেখানকার সীমান্তভিত্তিক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন নাসিমের ছোট ভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ওরফে পাপ্পু এবং চাচাতো ভাই ও পরশুরাম পৌরসভার সাবেক মেয়র নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ওরফে সাজেল। তারা পরশুরাম এলাকার বালুমহালসহ অবৈধ উপার্জনের অন্যান্য খাতও নিয়ন্ত্রণ করতেন বলেও স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।
অন্যদিকে ফেনীর পরশুরামের চিথলিয়ায় ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ। অভিযোগ রয়েছে, এই কলেজের জন্য ২০১৬ সালে স্থানীয়দের কাছ থেকে কিছু জমি জোর করে নামমাত্র মূল্যে লিখে নেওয়া হয়। পরে কলেজের আশপাশে প্রায় ৩০ একর জমি দখল করে নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ভয় দেখিয়ে, জোর করে নামমাত্র মূল্যে কৃষিজমি নিয়ে নেওয়া হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে শেহাব উদ্দিন লিটন, ইউনুস ভূইয়া, বেলাল হোসেন ভূইয়া, হুমায়ুন কবির ভূইয়া,
ছগির আহমদ ফোরকানসহ ৮ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে দু‘জন ভয়ে নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
তারা বলেছেন, নাসিমের লোকজন লাল পতাকা টানিয়ে দিয়ে জমি দখল করেন। লাল পতাকা টানানোর পর বলা হতো, এই জমিগুলো অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। পরে দেখা যায়, অধিগ্রহণ নয়, দখল করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী বলেন, তার পরিবারের দেড় বিঘা জমি জোর করে নিয়ে নেওয়া হয়। জমির মূল্য ১৫ লাখ টাকা হলেও পরিশোধ করা হয় ৫ লাখ টাকা।
মোসলেহ উদ্দিন নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, তার পরিবারের প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমি দখল করেছেন আলাউদ্দিন নাসিম। তার নিজের নামে ২০ শতাংশ জমি দানপত্র তৈরি করে লিখে নেন। এই জমির বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু তাকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩ লাখ টাকা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কলেজের অবকাঠামোর বাইরে বিশাল জমিতে বড় বড় ছয়টি পুকুর তৈরি করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। বিশাল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের গাছ রোপণ করা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন বলেন, এখানে বাগানবাড়ি তৈরির পরিকল্পনা ছিল আলাউদ্দিন নাসিমের।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ইতিমধ্যে অভিযোগ জমা পড়েছে। গত ১৫ বছরে তিনি অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন ও পাচার করেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। নাসিমের এক মেয়ে কানাডায় থাকেন।দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামার হিসাবের বাইরেও নাসিম ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে বিপুল অর্থসম্পদ রয়েছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।