মুহাম্মদ নূরে আলম: বছর ঘুরে আবারও এলো পবিত্র মাহে রমযান। প্রতি বছরের মতো পবিত্র রমযানের প্রথম দিনেই জমে উঠেছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজারের ইফতার বাজার। এ মাথা থেকে ও মাথা, ভরে উঠেছে হরেক রকমের ইফতারির আইটেমে। বসন্তের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে তার ঘ্রাণ। অভিজাত এলাকার মতো মহল্লায়ও বিক্রেতাদের হাঁকডাক রয়েছে। তবে মহল্লায় ইফতারের পদে নেই ভিন্নতা। গতানুগতিক সেই ভাজা-পোড়ায়ই ভরসা রাজধানীর মহল্লাবাসীর। তুলনামূলক দামে সস্তা আর হাতের নাগালে (মহল্লার কাছাকাছি) থাকায় পছন্দের শীর্ষে রয়েছে সেই নানা পদের ভাজাপোড়া। এদিকে রোজায় খেজুরের পর বেশি চাহিদা থাকে সব রকম রসালো ফলের। শুল্ক কমানোয় খেজুরের দাম এবার হাতের নাগালে থাকলেও আপেল, কমলা, মাল্টাসহ বিদেশি সব ফলের দাম চড়া। সরকার সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় আমদানি করা এসব ফলের দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৮০ টাকা। দাম বাড়ার জন্য বাড়তি দরে শুল্কায়ন ও ডলার সংকটকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বাজারে কিছু দেশি ফলের সরবরাহ ভালো। আনারস, কলা, পেয়ারা, বরইয়ের মতো ফলের সঙ্গে আগাম তরমুজও বাজারে আসতে শুরু করেছে। যে কারণে ক্রেতারা দেশি ফলের দিকে ঝুঁকছেন বেশি। যদিও সেখানেও স্বস্তি নেই দামে। গতকাল রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচা, মালিবাগ, রামপুরা ও কারওয়ান বাজারের ফল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে খুচরা পর্যায়ে বিদেশি ফলের দাম বেড়েছে।
গতকাল রোববার রোজার প্রথম দিনেই পুরান ঢাকার চকবাজার, নাজিরাবাজার, নারিন্দা, মিরপুর, মগবাজার, বেইলি রোড, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ইফতার ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক। ভিন্নরকম এসব ইফতারের ভেতর রয়েছে আস্ত মুরগির কাবাব, মোরগ মুসাল্লম, বটি কাবাব, টিকা কাবাব, কোতা, চিকেন কাঠি, শামি কাবাব, শিকের ভারী কাবাব, সুতি কাবাব, কোয়েল পাখির রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, জিলাপি, শাহি জিলাপি, নিমকপারা, সমুচা, আলাউদ্দিনের হালুয়া, হালিম, দইবড়া, কাশ্মীরী শরবত।
ঢাকার চকবাজার ইফতার বাজার: ঢাকার চকবাজার শাহী জামে মসজিদদের সামনের রাস্তা ঘুরে দেখা যায়, চকবাজারের রাস্তার দুই পাশেই ভ্রাম্যামাণ ইফতারের দোকান বসানো হয়েছে। আজ দুপুর থেকে চকবাজারের শাহি মসজিদের সামনে দোকানিরা ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতারি কেনার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভিড় করতে থাকে। বিকেলে বাড়ে ইফতারসামগ্রী কিনতে আসা মানুষের সমাগম। ক্রেতারা বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে পছন্দের আইটেম কিনতে দেখা গেছে। এছাড়া তৈরি করা হচ্ছে মুখরোচক নানা সুপরিচিত ঐতিহ্যবাহী খাবার। রাস্তার শুরু থেকেই হাজারও মানুষ লাইন দিয়ে ঢুকছে। কোনো দোকানের সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। সবাই যেন স্রোতের গতিতে ভেসে চলছে।
চকবাজারের ইফতারির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়’ নামের একটি বিশেষ ইফতারি। এটি কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়’ তৈরিতে মাংস, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, ডাবলি, বুটের ডাল, ডিম, মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচসহ নানা পদের খাবার আইটেম এবং হরেক ধরনের মসলা প্রয়োজন হয়। প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা দরে এটি বিক্রি হচ্ছে। চকবাজারের শাহী পরোটা ও ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বিক্রেতা মো. আল-আমিন মিয়া বলেন, প্রথম রোজায় বিক্রি একটু বেশি হয়েছে। মানুষ প্রথম দিকে কষ্ট করে হলেও ইফতার কিনছে কিন্তু এভাবে তো প্রতিদিন কিনবে না। মাংস, পেঁয়াজ, আটা, তেলসহ সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আমরাও দাম না বাড়িয়ে পারছি না। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরাও অপারগ। তবে গত বছরের তুলনায় দাম ১৯/২০ হবে।
লাবাং বিক্রেতা হাবিবুর রহমান বলেন, ক্রেতা আসছেন, দেখছেন, দাম জিজ্ঞাসা করছে কিন্তু কিনছে। যেভাবে দাম বেড়েছে তাতে অনেকেই চাহিদা অনুযায়ী কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। মানুষের হাতে টাকা নাই; টাকা না থাকলে কিনবেন কীভাবে? ইফতারসামগ্রী কিনতে আসা কাঠ ব্যবসায়ী মো. রাসেল হাওলাদার বলেন, প্রতি বছরই চকবাজারের ইফতারির স্বাদ নিতে আসি। এবার রমযানের প্রথম দিন চলে এলাম। আমার পরিবারে মা-বাবা ও ভাই-বোনসহ সবাই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ খাবারটি পছন্দ করেন। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করার সময় এই খাবারটি রাখতেই হয়। ৮০০ টাকা কেজি নিলাম। জিনিসের দাম বেড়েছে অনেক। এবারের আয়োজন বেশ জমজমাট হয়েছে।
বেইলি রোডের ইফতার বাজার: প্রথম রমযানেই জমে উঠেছে রাজধানীর বেইলি রোডের ইফতার বাজার। রমযানের শুরুতেই পছন্দের ইফতার কিনতে বেইলি রোডের নবাবী ভোজ ও বেইলি পিঠা ঘরে ক্রেতাদের বেশ ভিড় দেখা গেছে। নবাবী ভোজের বিভিন্ন আইটেমের হালিম কিনতে লাইন দিচ্ছেন ক্রেতারা। শান্তিনগর মোড়ে বিক্রি হতে দেখা গেছে হালিম, জিলাপি, জালি কাবাব, নানরুটি, সামী কাবাব, চিকেন চাপ, শিক কাবাবসহ বেশ কয়েকটি ইফতারসামগ্রী। দোকানের বাইরে বিকেল থেকে মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, সন্ধ্যার কিছু সময় আগে সবকিছু গরম পাওয়া যায় তাই সেসময় ভিড় জমে। রোজায় অন্য সময়ের চেয়ে বেশি ভিড় হয়।
গুলশান নিকেতন বাজার: গুলশান নিকেতন বাজারে ইফতারসামগ্রীর পসরা সাজিয়েছেন বিক্রেতা আবদুল হালিম। তিনি বলেন, প্রতি বছরই ইফতারি বিক্রি করি। মানুষ সাধারণত আসরের নামাজ পড়ে ইফতারি কিনতে আসতে শুরু করে। ইফতারের এক ঘণ্টা আগে থেকে ভিড় জমতে শুরু করে আর আধা ঘণ্টা আগে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রির তালিকায় পিঁয়াজু, ছোলা, মুড়ি আর বেগুনি রয়েছে। জিলাপিও কিনে বেশির ভাগ মানুষ।
দোকানগুলোতে দেখা মিলেছে ঐতিহ্যবাহী শাহী দই বড়া। বাটিতে বাটিতে সাজানো দই বড়ার দাম ১২০ থেকে ২৪০ টাকা। উন্মুক্তভাবে বানানো হচ্ছে বড় বড় শাহী জিলাপি, যার দাম সাড়ে ৩০০ টাকা। এরপরেই দেখা মিলেছে চিকেন বল ৩৫ টাকা, শাহী পরোটা ৮০-১২০ টাকা, স্পেশাল পরোটা ১৫০ টাকা, টানা পরোটা ৪০ টাকা, চিকেন নাগেট ৮০ টাকা, চিকেন লেগ ১০০ টাকা। আরও দেখা মিলেছে, খাসির রান ৮০০ টাকা, চিকেন তন্দুরি ১৫০ টাকা, চিকেন কারি ১৫০ টাকা, গরু কারি ১৬০ টাকা, মাঠা ১০০ টাকা কেজি, আস্ত গ্রিল ৭০০ টাকা, বিফ জালি কাবাব ১২০ থেকে ১৬০০ টাকা কেজি, খাসির জালি কাবাব ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি, কোয়েল পাখি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ছোট মুরগি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পিস, বড় মুরগি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পিস এবং বড় বাপের পোলায় খায় ৮০০ টাকা কেজি।
মিরপুরের জমজমাট ইফতার বাজার: নানান পদের ইফতারির পসরায় সাজানো মিরপুরের হোটেল-রেস্তোরাঁ-ফুটপাতের দোকানগুলো জমজমাট হয়ে উঠেছে। গতকাল রোববার প্রথম রোজায় দুপুরের পর থেকেই মিরপুর সাড়ে ১১ ও ১২ নম্বরের বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ-ফুটপাত ও অলি গলির ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো ভোজন রসিকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। তবে খাবারের দাম ও মান নিয়ে ক্রেতাদের কোনো অভিযোগ না থাকলেও বিক্রেতাদের দাবি, গতবারের তুলনায় এবার দাম কম।
বনলতা রেস্তোরাঁর এক বিক্রেতা বলেন, ‘বাসায় সবাই চপ ও ছোলা বানায়। বাইরে থেকে কাবাব বা হালিমটা নেয়। এবার ইফতারের দাম গত বছরের মতই। মাংসের দাম বেশি হওয়ায় দুই/একটা পণ্যের দাম সামান্য বেশি। ক্রেতারা আসছেন। বিক্রি বিকেলে জমবে। মিরপুর ১১ নম্বরে ইফতারসামগ্রী কিনতে এসেছিলেন বর্ধিত পল্লবী-১ এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম শফি। তিনি বলেন, ‘গ্যাস থাকে না। বাসায় ইফতার বানানো হয়নি। জিলাপি, চপ ও বেগুনি কেনার জন্য এসেছি। মিরপুর ১২ নম্বরের বাসিন্দা আকরা হোসেন বলেন, ‘বাসায় ইফতারি বানানো হয়েছে। কাবাব, লাচ্ছি ও জিলাপি কিনতে এসেছি। বাচ্চারা এগুলো খেতে পছন্দ করে।