রাজধানী
ছাত্র জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা
শহীদ হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী সন্তানকে দেখে যেতে পারলেন না
ময়মনসিংহে ২০ জুলাই ২০২৪ শহীদ হন কুরআনে হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিব (২১)। ২০২২ সালে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মরিচারচর এমদাদুল উলুম নুরানীয়া হাফিজিয়া মাদরাসা থেকে হাফেজিয়া পাস করেন তিনি। নিজ গ্রামে তার বাবার প্রতিষ্ঠিত
Printed Edition

ময়মনসিংহে ২০ জুলাই ২০২৪ শহীদ হন কুরআনে হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিব (২১)। ২০২২ সালে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মরিচারচর এমদাদুল উলুম নুরানীয়া হাফিজিয়া মাদরাসা থেকে হাফেজিয়া পাস করেন তিনি। নিজ গ্রামে তার বাবার প্রতিষ্ঠিত তালিমুল কুরআন মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে ২০ জুলাই ২০২৪ সকালে গৌরীপুরের কলতাপাড়া বাজারে গিয়েছিলেন রাকিব। তখন কলতাপাড়া বাজারে ছাত্র-জনতার সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। এ সময়ে তিনি মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছিলেন। আর তখনই পুলিশের গুলীতে শহীদ হন রাকিব। সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মারা যান। কুরআনে হাফেজ রাকিব গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়ার আব্দুল হালিম শেখের ছেলে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ছোট ছিলেন হাফেজ নূরে আলম রাকিব। ছেলে হত্যার ঘটনায় আবদুল হালিম বাদী হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। আমার মৃত্যুর পর জানাযায় ছেলে ইমামতি করবে সে জন্য তাকে হাফেজ বানিয়েছিলাম। একটি গুলী আমার একমাত্র সেই ছেলেকে কেড়ে নিল। এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিবের (২২) মা নুরুন নাহার। উল্লেখ্য, গৌরীপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কলতাপাড়া বাজারে নিহত অপর দুজন হলেন ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে বিপ্লব (১৯) ও মইলাকান্দা কাউরাট গ্রামের আনোয়ার উদ্দিনের (আইন উদ্দিন) ছেলে জুবায়ের (২১)।
বাবা ডাক আর শোনা হলো না জুলাই বিপ্লবে শহীদ হাফেজ রাকিবের: আমি বাবা হব, তুমি মা হবে, ঘর আলোকিত করবে আমাদের সন্তান। আমাকে রেখে দূরে কোথাও যেতেন না। সব সময় কাছে কাছেই থাকতেন। আমরা দু’জন সন্তানকে নিয়ে ভাবতাম। সব স্বপ্ন কেড়ে নিল একটা বুলেট। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সাদিয়া আক্তারকে এভাবেই স্বপ্নের কথা বলতেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিব। তিনি শহীদ হওয়ার ৬ মাস পর ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ রোববার ভোর ২টা ৩০ মিনিটে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কন্যাসন্তান জন্ম দেন সাদিয়া। কন্যা সন্তান নিয়ে সাদিয়া এখন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের পুনাইল গ্রামে বাবার বাড়িতে থাকছেন।
স্ত্রী সাদিয়া আক্তার জানান, গত বছরের ২০ জুলাই ২০২৪ ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের গৌরীপুরের কলতাপাড়ায় পুলিশের গুলীতে নিহত হন রাকিব। সাদিয়া আরও জানান, তার স্বামী সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। ও আসবে, ওর জন্য ঘর সাজাতে হবে। ও আমাকে স্পর্শ করে সন্তানের ছোঁয়া অনুভব করত। কত আবেগ-আপ্লুত ছিল সে। রাকিবের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার বলেন, তার সন্তান হবে, সেই জন্য বাবা হিসাবে রাকিব খুব আবেগ-আপ্লুত ছিল। সব স্বপ্ন একটি গুলীতে শেষ হয়ে গেল। সন্তান তার বাবার মুখ দেখতে পারল না। এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, আমার সন্তানের কী দোষ ছিল, সে কেন এতিম হলো। ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ রোববার সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে সন্তানকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের পুনাইল গ্রামে বাবার বাড়িতে যান সাদিয়া।
সাদিয়ার বাবা মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, একদিকে কষ্ট, অন্যদিকে আনন্দ! যে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হওয়ার কথা। সে তো নেই। সাদিয়ার ভাই শামীম আহমেদ বলেন, আমার ভগ্নিপতি শহীদ হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে। আমার ভাগ্নিটা যেন বৈষম্যের শিকার না হয়। সে যেন তার প্রাপ্য অধিকারটুকু পায়। মা জাহানারা বেগম বলেন, আমার নাতনি যখন কাঁদছে, আমাদের মনে হচ্ছে ও বাবা বাবা বলে চিৎকার করছে। ওর বাবাও হয়তো ওর কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
পরিবারের অভিব্যক্তি: রাকিব গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়ার আব্দুল হালিম শেখের ছেলে। জুলাই বিপ্লবে শহীদ ছেলের কন্যা সন্তান (নাতনী) হওয়ার খবরে হাসপাতালে ছুটে যান শহীদ হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিবের বাবা। তিনি বলেন, আমি দাদুভাইটাকে কোলে নিয়েছি। ও বাবাহারা, আমি সন্তান হারা; আল্লাহ যেন ওকে হেফাজত করেন। তিনি আরও বলেন, দুজাহানের শান্তির দূত হিসাবে ছেলেকে পবিত্র কুরআনের হাফেজ বানিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল ছেলে আমার মৃত্যুর পর আমার জানাযার ইমামতি করবে। একটি বুলেট আমার সেই ছেলেকে কেড়ে নিল। জুলাই বিপ্লবে শহীদ নূরে আলম রাকিবের বাবা আবদুল হালিম শেখ বলেন, নবজাতককে নিয়ে পুত্রবধূ তাঁর বাবার বাড়িতে গেছেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তাঁদের বাড়িতে আনা হবে। তিনি বলেন, এতিম হইয়া মাইয়াডা জন্ম নিল। আমি একমাত্র পুত হারাইয়া কষ্টে দিনগুলা পার করছিলাম। আমার পুতের চিহ্ন এই শিশু দেইখ্যা আমার কইলজাডা ফাইট্টা যাইতাছে।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। সেদিন পুত্রবধূর ওষুধ আনতে কলতাপাড়া বাজারে গিয়েছিল। সেখানে গণ্ডগোল হচ্ছে দেখে ভিডিও করছিল। তখনই একটি গুলী তার বুকে লাগে। কার কাছে বিচার চাইব? বিচারের মালিক তো আল্লাহ। তার কাছে ছেলে হত্যার বিচার চাই।
রাকিবের মা মোছা. নুরুন নাহার জানান, আন্দোলনের দিন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জন্য ওষুধ আনতে কলতাপাড়া বাজারে গিয়ে রাকিব শহিদ হন। রাকিবের মা আরও বলেন, আমার ছেলে কখনো তো কারও সঙ্গে ঝগড়া করেনি। তাকে কেন মেরে ফেলা হলো?
রাকিবের চাচাতো ভাই আব্দুল মালেক জানান, তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও মধুকণ্ঠের ছিলেন। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে সুনাম অর্জন করেন। ইসলামি সংগীতও পরিবেশন করতেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ঈশ্বরগঞ্জের ভাসা গফুলনগরে ভাসা আতহারিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসায় কিতাব বিভাগে লেখাপড়াও করছিলেন। রাকিব ২০২৪ সালের ১২ জানুয়ারি বিয়ে করেন। শহীদ হওয়ার সময় তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিল।
হাফেজের পরিবারের হাতে আর্থিক অনুদান প্রদান: জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিবের নবজাতক কন্যার পাশে দাঁড়িয়েছেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক। ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ বৃহস্পতিবার রাকিবের শ্বশুর শাহাব উদ্দিনের হাতে আর্থিক অনুদান তুলে দেন তিনি। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে আর্থিক অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে ছিলেন, ইউএনও এম সাজ্জাদুল হাসান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুনন্দা সরকার প্রমা, ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য হাফেজ আজিজুল হক।
মাহে রমযানে তারেক রহমানের উপহার পেল শহীদ হাফেজ রাকিবের পরিবার: গেল ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদ হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিবের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার। নতুন অতিথির আগমণের দুই দিন পর ২১ জানুয়ারি ২০২৪ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে সোনার আংটি দিয়ে শহীদ কন্যাকে বরণ করে নেয় ময়মনসিংহ উত্তর জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন পাপ্পু। এবার পবিত্র মাহে রমযান উপলক্ষে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে শহীদ হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিবের পরিবারকে মাহে রমযানের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী উপহার দেয়া হয়েছে।