রাজধানী
রহমত মাগফিরাত নাজাতের মাস রমযান
আজ পবিত্র রমযানের ৬ষ্ঠতম দিন। রহমতের দিন শেষের পথে। পবিত্র মাহে রমযানের রোজা পালনকারীদের জন্য যেমনি আল্লাহ অনেক সওয়াব ও সম্মানের কথা ঘোষণা করেছেন, মাহে রমযানুল মোবারকে সিয়াম বিধানের লক্ষ্য ঈমানদার
Printed Edition

মিয়া হোসেন : আজ পবিত্র রমযানের ৬ষ্ঠতম দিন। রহমতের দিন শেষের পথে। পবিত্র মাহে রমযানের রোজা পালনকারীদের জন্য যেমনি আল্লাহ অনেক সওয়াব ও সম্মানের কথা ঘোষণা করেছেন, মাহে রমযানুল মোবারকে সিয়াম বিধানের লক্ষ্য ঈমানদার ব্যক্তিদের তাকওয়া অর্জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে কুরআন মাজিদে। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি মহত্তম মানবিক চরিত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান।
পবিত্র রমযানে তাকওয়া অর্জনের জন্য আল্লাহ তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর শেষ নবীকে যে কয়টি মৌলিক দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন, তাতে রয়েছে উম্মাহর নৈতিকতার উৎকর্ষের বিষয়টি। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- (মহান আল্লাহ) সেই সত্তা, যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে প্রেরণ করেছেন তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূলকে, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতগুলো, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের শিক্ষা দেন কিতাব ও প্রজ্ঞা। নিশ্চয়ই তারা ইতঃপূর্বে ছিল স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। (সূরা জুমুয়া, আয়াত-২)
ইসলামের অন্যতম বিশেষত্ব এই যে, এতে নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত করা হয়নি; বরং উন্নত নৈতিকতার উপাদানগুলো ও দূষণীয় দিকগুলো স্পষ্টভাবে ও বিস্তারিত জানিয়ে দেয়া হয়েছে। মানবচরিত্রের যেসব দূষণীয় দিক রয়েছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রমযানে সিয়াম অত্যন্ত কার্যকর ও সহায়ক।
মহানবী সাল্লাল্লাহু অলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা অনুযায়ী পানাহারে মিতাচার উন্নত মানবচরিত্রের অন্যতম উপাদান। মাহে রমযান মু’মিনের জীবনে পানাহারে মিতাচার চর্চার সুযোগ এনে দেয়। রমযান মাসে কথায় ও কাজে মিতাচারী হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। রমযান মাসের এটিই শিক্ষা, এটিই বিধান।
আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের প্রথমেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, যারা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে, এ কিতাব থেকে কেবলমাত্র তারাই হেদায়াত পাবে এবং সঠিক পথে চলতে পারবে। “হুদাল্লিল মুত্তাকিন” অর্থাৎ তাকওয়া অর্জনকারীদের জন্য পথ প্রদর্শন। অপরদিকে রোজা রাখার উদ্দেশ্য বা রোজা রাখার ফল সম্পর্কে বলা হয়েছে “লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন” অর্থাৎ যাতে করে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়।
রোজার সাথে পবিত্র কুরআনের এতো সম্পর্ক কেন? কুরআন নাযিলের বর্ষপূর্তির মাসকে রোজা রাখার জন্য কেন নির্দিষ্ট করা হয়েছে? রোজার মাধ্যমে তাকওয়ার সে গুণ সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে হবে যার মাধ্যমে কুরআন নির্ধারিত পথ চলা সহজ হয়ে যায় এবং কুরআনের আমানতের বোঝা বহন করা সম্ভব হবে। এ কাজের জন্য এ মাসের বরকতপূর্ণ সময়ের চেয়ে আর কোন্ সময় উপযুক্ত হতে পারে?
তাকওয়া কি? তাকওয়া অত্যন্ত উঁচুদরের এবং অত্যন্ত মূল্যবান একটি গুণ এবং সকল কাক্সিক্ষত গুণের সমষ্টিও বটে। যাঁর মধ্যে তাকওয়ার গুণ রয়েছে তাঁকে আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে দুনিয়া ও আখেরাতের সমস্ত কল্যাণের জামানত দান করেছেন। তাকওয়া এমন একটি জিনিস, যার মাধ্যমে সকল সমস্যা মোকাবিলা করার পথ পাওয়া যায়। তাকওয়ার মাধ্যমে রিযিকের দরজা এমনভাবে উন্মুক্ত হয়, যা কল্পনাও করা যায় না। তাকওয়ার কারণে দীন ও দুনিয়ার সকল কাজ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং মহান পুরস্কার দান করেন। মুত্তাকীনদের জন্য এমন জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, যার প্রশস্ততার মধ্যে সমগ্র পৃথিবী ঢুকে যাবে। তাদের সাথে সেই মাগফিরাতের ওয়াদা করা হয়েছে যা মানুষকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। জান্নাত তাদের উত্তরাধিকার, দুনিয়াতেও আসমান ও যমীনের সকল বরকতের দুয়ার খুলে দেয়ার ওয়াদা তাঁদের সাথে করা হয়েছে যাঁরা ঈমান ও তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত।
“যদি লোকালয়ের লোকেরা ঈমান গ্রহণ করে আর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে আমরা তাদের জন্য আসমান ও যমীনের সমস্ত বরকত সমূহের দরজা খুলে দেবো।” -সূরা আল আরাফ : ৯৬
তাকওয়া কি? খুররম মুরাদ তার খোশ আমদেদ মাহে রমযান নামক বইতে বলেছেন, তাকওয়া হলো, অন্তর ও রূহ, জ্ঞান ও সচেতনতা, আগ্রহ ও ইচ্ছা, সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা, আমল ও কর্মতৎপরতার সেই শক্তি এবং যোগ্যতার নাম, যার প্রভাব বলয়ে আমরা সে কাজ থেকে বিরত হয়ে যাই, যাকে আমরা ভুল বলে মনে করি ও সাব্যস্ত করি এবং নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে করি। পক্ষান্তরে আমরা সে কাজের উপর দৃঢ় হয়ে যাই যাকে আমরা সঠিক মনে করি এবং সাব্যস্ত করি। তাকওয়ার আভিধানিক অর্থ “নিরাপদে থাকা”।
কোনো ধরনের ক্ষতি এবং আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার শক্তি আমাদের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবেই আছে। লাভের প্রতি লোভ এবং লাভের সন্ধানে চলতে থাকার আগ্রহ না থাকলে মানুষের বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ না হলে মানুষের উন্নতিও সম্ভব নয়। জ্বলন্ত আগুনে আমরা হাত দেই না, বরঞ্চ আমাদের হাত জ্বলন্ত আগুনের কাছ থেকে আপনা-আপনি দ্রুত ফেরত চলে আসে। আমাদের শিশু অজ্ঞতাবশতঃ আগুনের নিকটে গেলেই তাকে উদ্ধার করে জড়িয়ে ধরার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি, কিন্তু কেন? কেননা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, আগুনে আমাদের হাত পুড়ে যাবে, আগুনের নিকটবর্তী হলে আমাদের শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। এটা পার্থিব আগুন সম্পর্কে আমাদের তাকওয়া, এই আগুনের ক্ষতি সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এটা আমাদের চোখের সামনেরই ঘটনা। এছাড়া আরেক প্রকার আগুন রয়েছে। এ আগুন ঈমান, আমল, চিন্তা ও চরিত্রের বিপর্যয়ে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। সে আগুনে পড়া এবং জ্বলা কি সম্ভব? কোন্ পথে চললে এ পার্থিব আগুন এবং পরকালের আগুন থেকে বাঁচা যাবে? একথাই কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে। সে সতর্ক করছে ঐ পথগুলোর নিকটেও যেও না। ঐ আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর। একগুয়েমী, যুলুম, মিথ্যা, হারাম মাল, হক অস্বীকার করা, এই সবকিছুই আগুন।
এ আগুন আমরা চোখে দেখতে পারি না, এ ব্যাপারে আমাদের বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এ আগুনে হাত দিয়ে আমরা জ্বলার কষ্ট সাথে সাথেই উপলব্ধি করতে পারি না। পার্থিব আগুন আমরা দেখতে পাই বলে এর ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করি। এর মধ্যে পুড়ে গেলে সাথে সাথেই এবং এক্ষুণি জ্বালা অনুভব করি। এর ক্ষতি সম্পর্কে আমাদের পুরোপুরি দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। যদি ঠিক এমনিভাবে একথার উপর আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে যায় যে, মিথ্যা বলার সাথে সাথে জিহ্বা আগুনে জ্বলে, হারাম খেলে পেট আগুনের অঙ্গারে পূর্ণ হতে থাকে, অথবা হারাম পথে চললে আগুনের বিছানা এবং আগুনের খাওয়া-দাওয়া তৈরি হতে থাকে, তাহলে অবশ্যই আমাদের দেহ-মন জীবনে সেই শক্তি, যোগ্যতা সৃষ্টি হবে যা আমাদেরকে উল্লেখিত কাজগুলো থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবে।
এটা আল্লাহ এবং তাঁর আগুন সম্পর্কে তাকওয়া, এ তাকওয়ার প্রথম দৃষ্টি হচ্ছে অদৃশ্যে বিশ্বাস, “আল্লাজিনা ইউমিনুনা বিল গাইব” কুরআন থেকে হেদায়াত পাওয়ার জন্য যোগ্য মুত্তাকীগণ গায়েবের প্রতি অর্থাৎ অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখে। আজকের ঈমানের ত্রুটি এবং খারাপ কাজ আগামী কালের আগুন, যদিও আজকে আমরা তা দেখতে পাই না, এ অদৃশ্য কথার উপর দৃঢ় বিশ্বাসই তাকওয়া সৃষ্টি করে। এ দৃঢ় বিশ্বাস সেই শক্তির জন্ম দেয়, কুরআনের পথে চলার জন্য যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, এর মাধ্যমে চলার পথের সবচেয়ে দরকারি সম্বল তাকওয়া সংগৃহিত হয়।
তাকওয়ার উল্লেখিত হাকীকত সামনে রেখে একটু চিন্তা করার সাথে সাথেই বুঝা যাবে যে, তাকওয়ার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন চারিত্রিক সৌন্দর্য, কাজের মধ্যে ভুল ও শুদ্ধ, হক ও বাতিলের স্থায়ী বিধান এবং মানদণ্ড নির্ণয় করা এবং পাশাপাশি এর অনুসরণ করা। যারা বলে “আকীদা ও চরিত্রের মধ্যে ভুল ও শুদ্ধের কোনো সুনির্দিষ্ট অস্তিত্ব, বিধান বা মানদণ্ড নেই, এগুলো অপ্রয়োজনীয় বিষয়, এটা তো যুগ ও অবস্থার প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়, অথবা ব্যক্তি ঈমানদার হউক বা বেঈমান হউক এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাদের জন্য তাকওয়ার প্রশ্নই উত্থাপিত হতে পারে না।
আমরা আল্লাহ তাআলাকে আমাদের প্রভু হিসেবে স্বীকার করি। এর অর্থ হচ্ছে ন্যায় ও সঠিক শুধু সেটাই যার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। যা কিছু তাঁর নির্দেশ, যা কিছু করার জ্ঞান তিনি দান করেছেন, তাঁর অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করে এমন প্রতিটি জিনিস, তাঁর গজবে ইন্ধন যোগায় এমন প্রতিটি কাজ, যে কাজ করলে তাঁর আদেশ লঙ্ঘিত হয়, সেসব কিছুই ভুল এবং পরিত্যাজ্য, সেটা ক্ষতিকর এবং লোকসানের পথ। এসব থেকে আত্মরক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
আল্লাহ তাআলাকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করার অর্থ এও হয় যে, প্রকৃতিতে কিছু বস্তু এমনও আছে যা বাস্তবের চৌহদ্দীর বাইরে। যার দেহ বা জীবন নেই, যা ক্ষুধা ও পিপাসা থেকে মুক্ত, যা উপস্থিত কামনা পূরণের স্বাদের চেয়েও অধিক মূল্যবান।
ভুল-শুদ্ধের জ্ঞান শুধু তিনি দিতে পারেন, এবং ঐ বাস্তবতার জ্ঞানও শুধু তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া যেতে পারে, যাঁর নিকট দৃশ্য-অদৃশ্য উভয় জ্ঞানই রয়েছে এবং যাঁর ইচ্ছাই শুদ্ধ-অশুদ্ধের কষ্টিপাথর।
মোত্তাকি তাঁরা হতে পারেন যাঁরা এই অদৃশ্য নির্দেশাবলির উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন। একথাগুলোকে মেনে নেন, তাঁদের জন্য একটিই পথ আছে, অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের তন-মন-ধন সবকিছু পরিপূর্ণভাবে নিজেদের প্রভুর নিকট সমর্পন করবেন। তাঁদের ওঠা-বসা, চলা-ফিরা, বলা-শোয়া, সবকিছু আল্লাহর বন্দেগীর জন্য ওয়াক্ফ হয়ে যায়। যা কিছু তারা দিয়েছে সেটা সম্পদ হউক বা সময়, বস্তু হউক বা আত্মীক কিছু হউক, তাঁরই পথে লাগিয়ে দিবে এবং এ প্রয়োজনেই খরচ করে দেয়, পুরো জীবনটাই এ চিন্তায় অতিবাহিত করে যে, আগামীকাল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হবে। আর সে সময়ের সাফল্যই আসল সাফল্য।
এটাই তাকওয়ার সেই সূত্র যা আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদের শুরুতেই সূরায়ে বাকারায় বলে দিয়েছেন অদৃশ্যে বিশ্বাস, নামাযের মাধ্যমে দেহ-মনের ইবাদাত, তাঁর দেয়া সম্পদ থেকে তাঁর পথে ব্যয় করা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যের জন্য ওহীকে কষ্টিপাথর হিসেবে বিশ্বাস করা, এবং আখেরাতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা।
যারা আল্লাহকে নিজেদের প্রভু বলে স্বীকার করে অথচ নিজেদের দেহ-মনের শক্তিকে, নিজেদের সময় ও সম্পদকে আল্লাহর অপছন্দনীয় পথে লাগায়, এবং যে কাজে আল্লাহর অসন্তুষ্টির আগুন জ্বলে ওঠে সে কাজ থেকে বিরত হয় না, তারা তাকওয়া থেকে বঞ্চিত। তাকওয়া শুধু প্রকাশ্য কাজের অনুসরণের নাম নয়, এটা মনের গভীরে রক্ষিত শক্তি ও দৃঢ় বিশ্বাসের নাম। এ কারণেই রাসূলে করীম স. একদিন নিজের পবিত্র কলবের দিকে তিন তিনবার ইঙ্গিত করে বললেন, তাকওয়া তো এখানে থাকে। -মুসলিম : আবু হোরায়রা রা.।