২০১৭ সালে মানবিক দিক বিবেচনা করে মিয়ানমার থেকে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। অনেক বার উদ্যোগ নিলেও দীর্ঘ ৮ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। উল্টো গত কয়েক মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিয়েছেন ৬০-৭০ হাজার রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে আলাপকালে রোহিঙ্গারা জানায়, ক্যাম্পে আশ্রিত জীবন অনেকটা বন্দী জীবন। এমন জীবন তারা চায় না। দ্রুত নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চায় তারা। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ভূরাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব ২০১৮ সালে সর্বশেষ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শনে এসেছিলেন। তবে জাতিসংঘ মহাসচিবের এবারের সফরের মধ্যদিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখবে আশা বিশ্লেষকদের? প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এটি প্রথম রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন করে আশার আলো জ্বালালেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি ছুটে গেলেন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থানের কথাও তুলে ধরেছেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। ধারণা ছিল, পরিস্থিতি শান্ত হলে এক পর্যায়ে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু সেই মানবিকতা বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পরবর্তী সময়ে। গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে নানা সময়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা এখন ১২ লাখের বেশি। এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আগামী দিনে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বড় সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে মার্কিন প্রতিনিধি দল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের কাছে দ্রুত নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়েছে রোহিঙ্গারা। এজন্য মিয়ানমারের ওপর জোর চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানায় রোহিঙ্গারা। এছাড়াও ২০২৩ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোরসহ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত আছে এবং তা অব্যাহত রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাজ করে যাচ্ছে বলে সেই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা জানিয়ে ছিল।
উল্লেখ্য যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আট লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছিল। এরপর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬৮,০০০ রোহিঙ্গার একটি ফিরতি তালিকা পাঠানো হয়। গত ২০২৪ জানুয়ারিতে ওই তালিকা থেকে পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৪০ জনকে বাছাই করা হয় পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার সম্মতি দিলেও বাকি ৪২৯ জনের ব্যাপারে তাদের আপত্তি ছিল। সেই ৪২৯ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করতেই মিয়ানমারের ১৭ জন সদস্যের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছেন।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর ব্যাংককের থাইল্যান্ডে আয়োজিত এক অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রোডম্যাপ চেয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে স্থায়ী শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র দেখতে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে সেখানে ফিরে যাওয়ার আত্মবিশ্বাসের জন্য রাখাইন রাজ্যে একটি অনুকূল পরিবেশ দেখতে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। থাইল্যান্ডে মিয়ানমার ও তার প্রতিবেশী ৫টি দেশের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের এক অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কয়েক মাসে মিয়ানমার থেকে ৬০ হাজার লোকের অতিরিক্ত অনুপ্রবেশ বেড়েছে। তৌহিদ হোসেন রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একটি ব্যাপক রোডম্যাপের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
সূত্রে জানা যায়, শুরু থেকেই রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে চুক্তিও করেছিল। তবে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। এতে বাংলাদেশের ওপর সেই বোঝা শুধু বেড়েছেই। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি বরাদ্দ সীমিত হয়ে পড়ার পর রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন করে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন করে আশার আলো জ্বালালেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। গত শুক্রবার বাংলাদেশ সফরে এসে আজ তিনি ছুটে গেলেন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। দিনভর সেখানে কাটালেন। সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ছিলেন। তারা এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের সঙ্গে ইফতারও করেছেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থানের কথাও তুলে ধরেছেন।
একই অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি আশা করছেন, আগামী রোজার ঈদ রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে করতে পারবেন। তাদের এই বক্তব্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। এবার রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিলতে পারে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই উদ্যোগে রোহিঙ্গারাও তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। তারা নিজ দেশে ফিরতে উদগ্রীব বলে জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবকে নিজ দেশে ফেরার মতো পরিবেশ করতে অনুরোধ জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতারে অংশ নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, পবিত্র রমযান মাসে আমি সংহতির বার্তা নিয়ে কক্সবাজারে এসেছি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সংহতি জানাই। আর তাদের উদারভাবে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশি জনগণের প্রতিও আমার সংহতি রইল। আমি এখানে এসেছি শুধু তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরার জন্য নয়, বরং তাদের সম্ভাবনার ওপর বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও। এখানে বসবাসকারী ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আত্মসম্মানবোধ-সম্পন্ন। তারা সংগ্রামী। বৈশ্বিক সমর্থন তাদের প্রয়োজন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, কয়েক দশকের বৈষম্য ও নিপীড়নের পর আট বছর আগে রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ গণহত্যার ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা দেশ (মিয়ানমার) ছাড়তে বাধ্য হন। সম্প্রতি আরও অনেক রোহিঙ্গা এসেছেন, যারা নির্মম নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছেন, যা সামগ্রিকভাবে মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষকে উসকে দিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখানে এসেছেন সেই মৌলিক চাহিদার জন্য, যা বিশ্বের যেকোনো মানুষেরই থাকে সুরক্ষা, সম্মান এবং নিজেদের ও পরিবারের নিরাপত্তা। আমি আজ অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি ও কথা বলেছি তাদের সাহস আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আর তাদের দৃঢ়চেতা মনোভাব আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, অনেকেই মিয়ানমারে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং এখানে আসার পথের কষ্টকর অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন। তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চান মিয়ানমারই তাদের মাতৃভূমি। নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনই এই সংকটের মূল সমাধান।
এদিকে ইফতারে অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বলেছেন, এই ঈদে না হোক, তবে আগামী রোজার ঈদ যেন আপনারা নিজ মাতৃভূমিতে স্বজনদের সঙ্গে উদযাপন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবকে যে অনুরোধ জানিয়েছেন, আমরা তা গুরুত্বের সঙ্গে তার কাছে উপস্থাপন করছি। আপনাদের যত দ্রুত সম্ভব নিজ দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা যায়, আমরা নিরলসভাবে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদিকে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জানিয়েছেন, তারাও নিজ দেশে ফিরতে চান। তারা রাখাইন রাজ্য হওয়া গণহত্যার বিচার দাবি করেন এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে নিজ দেশে ফেরার পরিবেশ করার আহ্বান জানান।