রাজধানী
নতুন আতংকের নাম গ্যাস বিস্ফোরণ
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে রান্নাবান্নার জন্য গ্যাসের ব্যবহার বহুদিন ধরেই প্রচলিত। কিন্তু এই নিত্য প্রয়োজনীয় গ্যাস এখন বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসা বাড়িতে নতুন আতংক হয়ে দেখা দিয়েছে গ্যাস বিস্ফোরণ।
Printed Edition
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে রান্নাবান্নার জন্য গ্যাসের ব্যবহার বহুদিন ধরেই প্রচলিত। কিন্তু এই নিত্য প্রয়োজনীয় গ্যাস এখন বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসা বাড়িতে নতুন আতংক হয়ে দেখা দিয়েছে গ্যাস বিস্ফোরণ। লাইনের গ্যাস কিংবা সিলিন্ডার কোনো কিছুই যেন নিরাপদ নয়। নারায়ণগঞ্জসহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কিছুদিন পরপর গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ হচ্ছে। ঘটছে প্রাণহানি। এসব দুর্ঘটনার নেপথ্যে কেউ দায়ী করেন গ্যাস পাইপের লিকেজকে, আবার কেউ অসচেতনতাকে। সিদ্দিকবাজার, মগবাজার, সাইন্সল্যাব, ফেনীর মতো অসংখ্য ভয়াবহ ঘটনার পরও জননিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গ্যাস কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের বার্ষিক প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে গ্যাস লিকেজ থেকে ১১৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে ১৬টি অগ্নিকাণ্ড ও ৫টি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরে বেশ কয়েকটি গ্যাস বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ শনিবার রাতে চাঁদপুর পৌরশহরে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের ছয়জন দগ্ধ হয়েছেন। এর আগে ৩ মার্চ নারায়ণগঞ্জে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৮ জন দগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩ জন।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি বিস্ফোরণের পর বাসাবাড়িতে গ্যাস জমে থাকার বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাইনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে অসচেতনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটেছে। এর ফলে, বাসাবাড়িতে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়ে ভুগছেন অনেকেই। গ্যাসের উৎস চিহ্নিত করে নিয়মিত তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
জানা গেছে, বাসাবাড়িতে নিয়মিত ব্যবহার করা গ্যাসগুলোর মধ্যে থাকে প্রাকৃতিক গ্যাস ও লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি, যা অনেকের কাছে সিলিন্ডার গ্যাস হিসেবেও পরিচিত। প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপ বা এলপিজির সিলিন্ডারে ছিদ্র বা ‘লিকেজ’ হয়ে গ্যাস জমতে পারে। একই সঙ্গে বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা রেফ্রিজারেটর ও এয়ারকন্ডিশনার থেকে গ্যাস রিলিজ হবার সম্ভাবনা থাকে। বাসাবাড়িতে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এমন আরেকটি উৎস পয়নিষ্কাশন লাইন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, রাজধানীতে অগ্নি দুর্ঘটনার প্রায় ৩০ ভাগই গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে ঘটে। বিভিন্ন শহরে যে গ্যাস সরবরাহ লাইন সম্প্রসারিত হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। খোদ রাজধানীতে অর্ধশত বছরের পুরনো লাইনও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অবৈধ সংযোগ। গ্যাসের মতো অতি দাহ্য পদার্থের সঞ্চালন, সরবরাহ লাইন সংযোগ করতে হয় শতভাগ টেকসই, নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্তভাবে।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, এসব দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, দেশের গ্যাস সরবরাহ লাইন ও সংযোগ কতটা ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসাবাড়িতে গ্যাসলাইন বসানোর কাজ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু তারা একবার লাইন বসানো ও সংযোগ দেওয়ার পর খোঁজও নেয় না, সেটি কী অবস্থায় আছে। অনেক সময় গ্রাহক তাদের সহায়তা চেয়েও পান না। বাধ্য হয়ে তারা আনাড়ি মিস্ত্রিকে দিয়ে মেরামতের কাজ করান। ফলে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক বড় দুর্ঘটনা।
রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত জানান, মিথেন গ্যাস অন্য গ্যাসের চেয়ে হালকা। তাই বদ্ধ ঘরের লাইনে খুব ছোট কোনো ছিদ্র থাকলেও সেই গ্যাস ঘরের ছাদ বরাবর জমা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটি জমতে জমতে যখন ঘরের মধ্যে থাকা মোট বায়ুর মাত্র ৫ থেকে ১৫ শতাংশ মিথেন গ্যাস হয়, সেটি সামান্য স্ফুলিঙ্গেই বোমার মতো বিস্ফোরণ ঘটায়। অতিদাহ্য পদার্থের কারণে কোথাও যদি ফ্লেমেবল মিক্সচার তৈরি হয় তাহলে যেকোনো জায়গা থেকেই এনার্জিটা আসতে পারে এবং বিস্ফোরণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চাপ বেশি হলে গ্যাস লিক হয়, আর চাপ কম থাকলে লিক হয় না। তার মানে, লিক হয়। ত্রুটিপূর্ণ সিস্টেম দিয়ে গ্যাস সার্ভিস দিচ্ছে। জীবন বিপন্ন করে ফেলেছে। কত বড় দায়বদ্ধতার ওপরে উঠলে এই কাজ তারা করতে পারে ? আমরা দাবি করে আসছি যে, এই মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করতে হবে। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের নাম আসতে হবে। সরকারের করা বিধিমালায় গন্ধ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু বিপণন কোম্পানিগুলোর এমন দায়হীন আচরণের কারণে জননিরাপত্তা এখন চরম হুমকিতে। গন্ধ নাই, তাই ছিদ্রও নাই, তাই গ্যাস লিকেজের কোনো দায়ও নাই। এই নীতির কারণে আমরা যে কত বড় ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছি তা আন্দাজও করতে পারছি না।
প্রধান বিস্ফোরক অধিদপ্তর সূত্র বলছে, দুর্ঘটনাগুলো মূলত গ্যাসের লিকেজ থেকে ঘটে। সিলিন্ডারের হোসপাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভের মতো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের ত্রুটির কারণে গ্যাস লিক হয়। সেই লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে বাইরে কোথাও জমতে থাকে। সামান্য আগুন, এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমে থাকা সেই গ্যাস ভয়াবহ বিস্ফোরণের সৃষ্টি করে।
গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনার পর সাধারণত তদন্ত করে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। তাতে গতানুগতিক কিছু সুপারিশ থাকে বলে অভিযোগ আছে। বিশেষ কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষতি কমানো যায় কিনা সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা থাকে না।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালে তৈরি করা প্রাকৃতিক গ্যাস নিরাপত্তা বিধিমালায় বলা হয়েছে, বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের আগে অবশ্যই বিশেষ গন্ধ যুক্ত করতে হবে, যাতে করে গ্যাস বের হলে সবাই বুঝতে পারে। কিন্তু এখন গ্যাস থেকে সেই গন্ধ আর পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কি গন্ধ আর ব্যবহার করছে না কর্তৃপক্ষ? না করলে, কেন করছে না?
২০২১ সালের ২১ জুন রাতে মগবাজারে বেঙ্গল মিটের একটি দোকানে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মারা যায় ১২ জন। এরপর ২৩ সালের ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে এক মুহূর্তের বিস্ফোরণে ধসে পড়ে একটি সাততলা ভবন। মারা যায় ২৬ জন। পুলিশের তদন্ত বলছে, দুটি ঘটনার পেছনেই কারণ ছিলো তিতাসের লাইন থেকে জমা হওয়া গ্যাস।
জানা গেছে, গ্যাস বিপণনের মোট ছয়টি কোম্পানির মধ্যে জালালাবাদ ও সুন্দরবন ছাড়া বাকি চারটি কোম্পানির ১৩টি স্থানের গ্যাসের ওপর চালানো পরীক্ষায় কেবল বাখরাবাদ কোম্পানির অধীনে থাকা কুমিল্লায় খুব সামান্য গন্ধকারকের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও ফেনীতে সেটি পাওয়া যায়নি। অন্য তিনটি কোম্পানি তিতাস, কর্ণফুলী ও পশ্চিমাঞ্চলেও কোনো গন্ধ সৃষ্টিকারী উপাদান মেলেনি।
দুর্ঘটনার কয়েকটি পরিসংখ্যান : চাঁদপুর পৌরশহরে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের ছয়জন দগ্ধ হয়েছেন। শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে শহরের কোরালিয়া রোড রুস্তম বেপারী বাড়িতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দগ্ধদের মধ্যে আব্দুর রহমান, শানু বেগম, খাদিজা আক্তার ও মঈন নামে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে। অপর আহত ইমাম হোসেন ও দিবা আক্তার চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
গত ৩ মার্চ দিবাগত রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের ঢাকেশ্বরী এলাকায় গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে নারী, শিশুসহ ৮ জন দগ্ধ হয়। এর মধ্যে ৩ জন মারা গেছে। এর আগে ২ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। গত বছরের ১২ নবেম্বর সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুরে গ্যাসের মেইন লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ৭ শ্রমিক দগ্ধ হন।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় একটি আবাসিক ভবনে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণে ১১ জন দগ্ধ হয়। গত ১৬ এপ্রিল ’২৪ গাজীপুরে সিলিন্ডার লিকেজ হয়ে কক্ষে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ হয়েছে। এতে অগ্নিকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীসহ দুজন দগ্ধ হয়েছেন। গত বছরের ২৭ মার্চ ঢাকার ধামরাইয়ে গ্যাস সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে দগ্ধ একই পরিবারের চারজনের মধ্যে তিনজন মারা গেছে। গত বছরের ২৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে ‘ঘরে জমে থাকা’ গ্যাস বিস্ফোরণে একই পরিবারের ছয়জন দগ্ধ হয়েছেন। গত বছরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গ্যাস বিস্ফোরণে দুজন দগ্ধের ঘটনা ঘটে। দগ্ধরা হলেন মোছা. আইরিন (৩২) ও মোছা. জান্নাত (২৪)। গত বছরের ১ নবেম্বর রূপগঞ্জে গ্যাসলাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ইসমাইল হোসেন ও সোহেল মিয়া নামে দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর এবার প্রাণ হারালেন বাবা বাবুল মিয়া ও মেয়ে তাসলিমা আক্তার। ২৬ এপ্রিল ২৩ পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় একটি বরফ মিলের গ্যাস বিস্ফোরণে রাসেল খান (৪২) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় দগ্ধ হয়েছে আরও ছয়জন।
তিতাস সূত্রে জানা গেছে, তিতাসের পাইপলাইনগুলো ৬০/৭০ বছরের পুরোনো। পাইপে কিছু কিছু ছিদ্র রয়েছে, চাপ বাড়লে সেখান দিয়ে গ্যাস বের হয়। মারকেপটেন দেয়া হচ্ছে কিন্তু বেশি দেয়া হচ্ছে না।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, ‘গ্যাস বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে আমরা প্রায়ই দেখি অনেক গ্যাসের লাইনের রাইজার থেকে গ্যাস লিক করে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলেও পাইপ জরাজীর্ণ হয়ে লিক হয়। সেই লিক থেকেই দীর্ঘক্ষণ দরজা-জানালা বন্ধ রাখলে চেম্বার তৈরি হয়, পরে আগুনের সংস্পর্শ পেলে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমরা মহড়াসহ বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছি। বাসাবাড়িতে সংঘটিত বিস্ফোরণে আমাদের তদন্তে দেখা গেছে, এসবের অধিকাংশই ছিল গ্যাস লিকেজ বা চুলা জ্বালিয়ে রাখার মতো ঘটনা। ফলে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।’