DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

রাজধানী

ছাত্র জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা

মাদরাসা শিক্ষার্থী শহীদ রিতার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পুলিশের গুলীতে শেষ

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লব চলাকালে রাজপথে মাদরাসার নারী শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়েছিল মেধা না কোটা; মেধা মেধা, এক দফা এক দাবি খুনি হাসিনা কবে যাবি, লাশের ভেতর জীবন দে নয়লে

মুহাম্মদ নূরে আলম
Printed Edition
P-1e

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লব চলাকালে রাজপথে মাদরাসার নারী শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়েছিল মেধা না কোটা; মেধা মেধা, এক দফা এক দাবি খুনি হাসিনা কবে যাবি, লাশের ভেতর জীবন দে নয়লে গদি ছাইরা দে, জ¦লেছে জ¦লেছে রক্তে আগুন জ¦লেছে, ক্ষমতা না জনতা; জনতা জনতা। কি এক অন্যন্য বিপ্লবী দৃশ্য ছিল সেই সময়গুলোতে, ভাবা যায়! ২০২৪ এর জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো আন্দোলনে রাজপথে নারীদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি দেখা যায়নি। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবে মাঠে উপস্থিত থাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কলাকৌশল সমন্বয়সহ সবখানে অবদান রেখেছেন মাদরাসার আলেম, ছাত্র ও মাদরাসার নারী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায়ে অহিংস আন্দোলনের বিপরীতে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলী চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করলে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মাদরাসার নারী শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আন্দোলন চালিয়ে ছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। জুলাই বিপ্লবে পোশাককর্মী, গৃহিণী, মা, চিকিৎসক, নার্সসহ সব শ্রেণী পেশার নারী রাস্তায় এক কাতারে সমবেত হন। স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ও অনলাইনে সক্রিয় ছিলেন। একদিকে যেমন নারীরা মাঠে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সুসংগঠিত করেছেন শিক্ষার্থীদের; তেমনি চিকিৎসক-নার্সরা আহত ছাত্র-জনতাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন, কর্মজীবী ও গৃহিণী মায়েরা রাস্তায় পানি ও খাবার খাইয়েছেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের এক প্রতিবেদনে জুলাই বিপ্লবে ১১ জন নারী শহীদের কথা উল্লেখ করেন।

তেমনি এক মহৎপ্রাণ দেশের তরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন জয়পুহাট থেকে দাখিল পাশ করে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা এসে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন রিতা আক্তার। জয়পুরহাটের দরিদ্র পরিবারের সন্তান রিতাকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিলো আকাশছোঁয়া। মেয়ে ডাক্তার হবে, সংসারের হাল ধরবে, অভাব পূরণ করবে। সংসারের অভাব মেটাতে আর মেয়েকে ভালোভাবে পড়ালেখা করাতে সপরিবারে ঢাকায় গিয়েছিলেন রিকশা শ্রমিক আশরাফ আলী। কিন্তু ঘাতক পুলিশের বুলেট তছনছ করে দিল সব। মাত্র একটি গুলীতেই শেষ হয়ে গেল রিতা আক্তারের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। মাঝপথে থেমে যায় তার স্বপ্নের গাড়ি। স্বপ্ন পূরণ করে নয়, রিতা বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। আর মেয়ের অকাল মৃত্যুতে শোকাহত পরিবার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরে এলো গ্রামে।

উল্লেখ্য যে, জুলাই বিপ্লবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মাদরাসার ৭৭ জন আলেম-শিক্ষার্থী শহীদ হওয়ার তথ্য জানিয়েছে “তরুণ আলেম প্রজন্ম” নামের সংস্থাটি। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সংস্থাটি এক সাংবাদিক সম্মেলন করে ৭৭ জন আলেম-শিক্ষার্থী তালিকা প্রকাশ করে। তাদের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা কোথায় আহত হয়েছেন বা শহীদ হয়েছেন সবগুলো পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় থাকা প্রথম শহীদ হলেন নারী শহীদ রিতা আক্তার, পিতা আশরাফ আলী, মাতা রেহানা আক্তার। স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম-তালখুর, ইউনিয়ন-পুনূট, উপজেলা-কালাই, জেলা-জয়পুরহাট। বর্তমান ঠিকানা বাসা-ব্লক-এইচ রোড নং-১০ মিরপুর-২। শহীদ হওয়ার সময় রিতা আক্তারের বয়স ছিল ১৬ বছর, তিনি সাবেক শিক্ষার্থী ভুগোইল হিজবুল্লাহ দাখিল মাদরাসা। ৫ আগস্ট ২০২৪ মিরপুর-২ বাসস্ট্যান্ড এলাকার ওভার ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে তিনি শহীদ হন।

হতদরিদ্র আশরাফ আলী (৫২) ও রেহেনা বিবি (৪৫) দম্পতির কন্যা রিতা আকতার। তিন ভাইবোনের মধ্যে রিতা দ্বিতীয়। বড় ভাই রাকিবুল ইসলাম (২২) পেশায় দিনমজুর। ছোট ভাই রোকন ইসলাম (১১) স্থানীয় শান্তিনগর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। রিকশা চালক স্বামীর একার আয়ে সংসারের প্রয়োজন মিটতো না। তাই রেহেনা বিবিও সেখানে গৃহকর্মীর কাজ নেন। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় রিতাই ছিল পরিবারের একমাত্র আশা-ভরসা। বাবা-মাকে সবমসময় বলত, বড় হয়ে ডাক্তার হবে, পরিবারের হাল ধরবে। মেয়েকে একটু ভালোমতো পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করে দিতে সাধ্যের সব চেষ্টা চালাতেন বাবা-মা। মা রেহেনা বিবি বাসাবাড়িতে কাজ করে আয়ের সেই টাকায় মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতেন। মেয়ে মাধ্যমিকের পাশ করার পর উচ্চমাধ্যমিকে শহুরে প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করানোর জন্য বাবা সপরিবারে আসেন ঢাকায়। মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করান মেয়েকে। মেয়ের পড়ালেখার সুবিধার জন্য কলেজের পাশেই মিরপুর-২ এইচ ব্লকে কম ভাড়ায় একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নেন।

রিতার মা রেহেনা বিবি বেদনাহত কন্ঠে বলেন, মেয়েকে আর ফিরে পাবো না জানি। কিন্তু আমার মেয়েসহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সকলেই যেন শহীদি মর্যাদা পায়। তাহলে মেয়েকে হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। গ্রামের মাদরাসা থেকে দাখিল পাশ করে এ বছরই ঢাকার মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন রিতা আক্তার। মেয়ের লেখাপড়ার সুবিধার্থে পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে যান। সেখানে তারা মিরপুর ২ মডেল থানার অধীন এইচ ব্লক ১০ নং রোড এলাকায় ভাড়া থাকতেন।

রেহেনা বিবি বলেন, ৫ আগস্ট ২০২৪ সকালে স্বামী-স্ত্রী কাজে বের হয়ে যাই। এরপর বেলা ১০/১১ টার দিকে মেয়ে বের হয় ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে। দুপুরে বাসায় এসে দেখি মেয়ে নাই। একটু পরে গুলীতে আহত হওয়ার খবর পেয়ে মেয়েকে খুঁজতে যাই। মেয়েকে না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে শুরু করি। এদিকে রিতা আকতারের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মা রেহেনা বিবি। মেয়ের জন্যে এখনও তিনি তার কান্না থামাতে পারছেন না। প্রথমদিকে তিনি বার বার মুর্চ্ছা যেতেন। এখনও তিনি বিপুল শোকের সাগরে ভাসছেন। তিনি বলেন, রিতা ছিল অনেকের থেকে আলাদা। ওর মতো মেয়ে যার ঘরে থাকবে তারা অবশ্যই ভাগ্যবান হবেন। আমার মেয়ে কখনোই কোন অন্যায় করেনি। আমরা দুজনেই বাইরে কাজে গেলে সংসারের ছোট ছোট কাজ গুলো রিতা নিজেই করে ফেলতো।

ভূগোইল হেজবুল্লাহ দাখিল মাদরাসার সুপার আবদুল মনয়েম এবং গণিত বিষয়ের শিক্ষক ও প্রতিবেশী সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘রিতা আক্তার আমাদের প্রিয় ছাত্রী ছিল। কোনদিন ওকে কারও সাথে খারাপ ব্যবহার বা ঝগড়া করতে দেখিনি। রিতাকে হারিয়ে ওর পরিবারের মতো আমরা এলাকাবাসীও শোকে কাতর। ইসলামী গান, হামদ, নাতে রাসুল বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কয়েকবার প্রথম হয়েছে রিতা। ওকে নিয়ে শিক্ষকদেরও অনেক স্বপ্ন ছিলো।

যেভাবে শহীদ হন রিতা আক্তার: ৫ আগস্ট ২০২৪ সকালে বাবা বের হয়ে যান রিকশা নিয়ে, মা যান বাসাবাড়িতে কাজে। এ সুযোগে রিতা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যান মার্চ-টু-ঢাকা কর্মসূচিতে যোগ দিতে। দুপুরে মা ঘরে ফিরে দেখেন মেয়ে নেই। খুঁজতে বের হন। আশপাশে অনেক খোঁজাখুঁজির পর কোথাও পেলেন না মেয়েকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মেয়ের খোঁজ না পেয়ে মেডিকেল কলেজগুলোর মর্গে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এক মেডিকেল থেকে আরেক মেডিকেল দৌড়াদৌড়ি করে রাত ১০টার পর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে মেয়ের লাশ পান। গায়ের জামাকাপড় দেখে মেয়েকে শনাক্ত করতে পারেন তিনি।

আহত রিতাকে মেডিকেলে নিয়ে আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরিবার জানতে পারে, তার মাথার এক পাশ দিয়ে গুলী ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল নিয়ে আসলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পেতে বিলম্ব হয়। ডাক্তার যখন রিতার চিকিৎসা করতে যান ততক্ষণে আর বেঁচে নেই রিতা। পরদিন মেয়ের লাশ নিয়ে বাবা-মা চলে যান গ্রামের বাড়ি। গ্রামের কবরস্থানে রিতাকে দাফন করা হয়।

জামায়াতের পক্ষ থেকে শহীদ রিতার পরিবারকে অনুদান প্রদান: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ রিতার পরিবারের সাথে রাজনৈতিক দল জামায়াত ও বিএনপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বলে জানিয়েছে তার পরিবার। শুক্রবার (৩০ আগস্ট ২০২৪) বিকালে কালাই উপজেলা জামায়াতের নেতৃবৃন্দ আন্দোলনে শহীদ রিতার কবর জিয়ারত শেষে জামায়াতের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারকে নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা আমীর মো. আব্দুর রউফ, সেক্রেটারি মো. আব্দুল আলীম, নায়েবে আমীর মো. মুনছুর রহমান, পুনট ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর মো. আজিজুল হক সহ স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতৃবৃন্দ।

তবে কালাই পৌরসভার পক্ষ থেকে তার পরিবারকে ২০ হাজার টাকার অনুদান দেয়া হয়েছে। যদিও এ অনুদান একেবারে যৎসামান্য।