DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

রাজধানী

রহমত মাগফিরাত নাজাতের মাস রমযান

পবিত্র রমযান মাস গোনাহ মাফের মাস। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে জীবনের জানা অজানা গোনাহের ক্ষমা লাভ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। আর এ জন্য আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী ইবাদত বন্দেগী করতে হবে।

Printed Edition
afaf

মিয়া হোসেন : পবিত্র রমযান মাস গোনাহ মাফের মাস। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে জীবনের জানা অজানা গোনাহের ক্ষমা লাভ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। আর এ জন্য আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী ইবাদত বন্দেগী করতে হবে। হাদীসে এসেছে এ সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বেশি করে এ দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নী’ অর্থাৎ হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে তুমি ভালবাস, সুতরাং আমাদেরকে তুমি ক্ষমা করে দাও।

রোজা এমন একটি ইবাদত যার মধ্যে কোন রিয়া নেই। রোজার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ দিবেন। ইবনে মাজাহতে আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেছেন- ‘আসসাওমুলী ওয়া আনা আযযীবিহী অর্থাৎ রোজা আমার জন্য আর এর প্রতিদান আমিই দিব। কাযী আয়ায বলেছেন, প্রত্যেক ইবাদতের মধ্যে রিয়া বা লোক দেখানো বা লৌকিকতার সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু রোজার মধ্যে এর সম্ভাবনা নেই। যেমন কেউ রুকু, সেজদা, বৈঠক ইত্যাদি করলো সবাই বলবে নামায পড়ছে। হজ্বে গিয়ে অনুষ্ঠানাদি পালন করলে বলবে হাজী। কিন্তু কেউ গোপনে খেয়ে দেয়ে মানুষের সামনে যতই বলুক আমি রোজা রেখেছি প্রকৃতপক্ষে সে রোজাই রাখেনি। নামায, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত আল্লাহ ফরজ করেছেন ঠিকই তবে এদের পরিপূর্ণ বর্ণনা কুরআনে নেই। রোজার ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সকল বিধান সবিস্তারে যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, অন্যান্য ফরয ইবাদতের তেমন বর্ণনা দেয়া হয়নি। সূরা আল বাকারার ১৮৩, ১৮৪, ১৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, রোজা ফরজ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্যও বলা হয়েছে যেন তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো। সময় সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘নির্ধারিত কত দিন। কোন মাসে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে রমযান মাসে। রমযান মাসে কেন? কেন অন্য মাসে নয় তার উত্তরে বলা হয়েছে যে, এ মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। আবার রোজা পালন করতে না পারলে কি করতে হবে, অসুস্থ, রোগী, মুসাফিরের জন্য করণীয় কি তাও আল্লাহ বলেছেন যা অন্য কোন ইবাদতের ব্যাপারে বলা হয়নি। যেমন নামায, যাকাত আদায় করতে না পারলে এর কাযা ও কাফফারা কিভাবে আদায় করতে হবে তা আল কুরআনে বলা হয়নি বরং রসূল (সাঃ) সবিস্তারে বলে দিয়েছেন। কিন্তু রোজার কাযা ও কাফফারা কখন ও কিভাবে করতে হবে তা আল্লাহ তা’আলা বলে দিয়েছেন। সূরা আল বাকারার ১৮৪ ও ১৮৫ নং আয়াতে তা বলে দেয়া হয়েছে। এদিক থেকেও রোজার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বেশি। প্রতি রোজার পরিব্যাপ্তি কতটুকু হবে তাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। ‘তোমরা রাত্র পর্যন্ত রোজা পরিপূর্ণ করো।’ সন্ধ্যায় ইফতারের পর খাওয়া-দাওয়া, সহবাস করা যাবে কিনা তাও বলে দিয়েছেন। সূরা আল বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, খাও, পান করো সন্ধ্যার সাদা আভা স্পষ্ট হবার পর থেকে ফজরের কালো রেখা স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত। এ সময়ে স্ত্রী সহবাস বৈধ কিনা এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘সিয়ামের রাত্রিতে স্ত্রী সহবাস তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে?

রোযার উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি সৃষ্টি করা, আর পবিত্র রমযান মাস হচ্ছে আল্লাহভীতির মান উন্নয়নের বসন্ত মৌসুম। এ কারণে এ মাসে আল্লাহর আনুগত্যহীনতা থেকে আত্মরক্ষার জন্য বিশেষভাবে প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন। এর অর্থ এই নয় যে, রমযান ছাড়া অন্যান্য মাসের দিন ও রাত্রিতে আল্লাহর আনুগত্যহীনতা থেকে আত্মরক্ষা করার প্রচেষ্টা প্রয়োজন নেই। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, পবিত্র রমযান মাসে কুরআন মাজীদের সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন। এ মাসে শুধুমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য সারাদিন ক্ষুধার্ত এবং পিপাসার্ত থাকা, রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়া এবং এর মাধ্যমে তাঁর কালাম শ্রবণ করার কারণে একটা বিশেষ পরিবেশ এবং একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতির ফলে নিজের মধ্যে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন প্রতিটি কাজ থেকে বিরত থাকার আগ্রহ গভীর ও শক্তিশালী করতে পারে।

এমনিতে তো এ প্রচেষ্টা জীবনের প্রতিটি কাজে অব্যাহত রাখতে হবে, কিন্তু অন্য একজন মানুষের সাথে সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন এবং সমষ্টিগত চারিত্রিক সম্পর্কের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। যে খুব যত্ন সহকারে রোযা রাখে, নামায পড়ে, সাদকা দেয়, কুরআন পড়ে, অথচ কেয়ামাতের দিন মানুষের অসংখ্য দাবির এক বিরাট বোঝা ঘাড়ে করে হাজির হয় সেই ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্ভাগা। কাউকে মেরেছে, কাউকে গালমন্দ করেছে, কাউকে অসম্মান করেছে, কারোর মনে আঘাত দিয়েছে, অবৈধভাবে কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে-নবী করীম স. বলেছেন, এমন ব্যক্তির সমস্ত নেকী দাবীদারদেরকে দিয়ে দেয়া হবে, তারপরও দাবী শেষ হবে না। এরপর দাবিদারদের গুনাসমূহ তার মাথায় তুলে দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত তাকে নিমিষে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে।-মুসলিমঃ আবু হুরায়রা রা.।

কুরআন মাজীদে যেখানে রোযা ফরয করা হয়েছে, সেখানে, এটাই সেই মৌলিক উদ্দেশ্য, রোযার মাধ্যমে যা অর্জন করা উচিত। প্রথমে মানব জীবনের মর্যাদা ও কেসাসের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতপর রোযা ও রমযানের বর্ণনা করা হয়েছে। পরক্ষণেই উপদেশ দেয়া হয়েছে, একে অপরের সম্পদ অবৈধ ও অন্যায়ভাবে ভোগ করো না। এরপর এ সূত্রটি বলা হয়েছে যে, বিশ্বস্ততা এবং নেকীর কাজ বাধ্যতামূলক প্রকাশের বিষয় নয়, মূল চাহিদা হচ্ছে তাকওয়া এরপর আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তাআলা তাদের পছন্দ করেন না, তাই যুদ্ধের মধ্যেও বাড়াবাড়ি চলবে না।

রোযা রাখার পর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অপর কোনো মানুষের জীবন, সম্পদ, অধিকার এবং ইজ্জতের উপর হস্তক্ষেপ করবেন না। এক বাণীতে নবী করীম স. এভাবে বর্ণনা করেছেন "গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য রোযা ঢালের মতো কাজ করে" তাই একে সত্যিকার অর্থে ঢাল বানান। রোযাদার না কোনো খারাপ কথা বলবে আর না চিৎকার করবে, যদি কেউ তাতে খারাপ কথা বলে বা তার সাথে বিবাদ করতে আসে, তাহলে সে বলবে "আমিতো রোজাদার, তুমি দূরে যাও, এসব খারাপ কাজে লিপ্ত হওয়া আমার জন্য সমীচিন নয়।"-বুখারী, মুসলিমঃ আবু হুরায়রা রা.

এ বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, রোযা শুধু পেটের রোজাই নয়, চোখের রোজা, কানের রোজা, মুখের রোজা, হাত-পায়ের রোজা। এ রোজার অর্থ হচ্ছে চোখ সেসব কিছু দেখবে না, কান সেসব কিছু শুনবে না, মুখ সেসব কিছু বলবে না, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সেসব কাজ করবে না-যেসব আল্লাহ তাআলা অপছন্দ করেন এবং যা কিছু করতে তিনি নিষেধ করেছেন।

নিজের খারাপ কাজগুলোর মধ্যে এক একটি করে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে অনেক কাজ হতে পারে। যেমন, রমযান মাসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে, এ মাসে চিৎকার করে কথা না বলা, ঝগড়া না করা এবং সম্মুখে বা পশ্চাতে কারোর ব্যাপারে কোনো কথা না বলা, আর যদি বলা হয়, যেন ভালো কথা বলা হয়, নির্দেশ অমান্য করা থেকে বাঁচার কাজ জিহ্বার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শুরু করতে হবে। এটা অবশ্যই কঠিন কাজ, তবে এটা মেনে চলতে পারার সম্ভাবনা বেশি। প্রতি রাতে এ দুটি পর্যালোচনা করার পর কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মাফ করিয়ে নিতে হবে।