রাজধানী
পুলিশের ওপর হামলা করছে কারা
পাঁচ আগস্টের পূর্বে পুলিশ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কতিপয় সদস্য বিরোধী মত দমনে দলীয় ক্যাডার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
Printed Edition

পাঁচ আগস্টের পূর্বে পুলিশ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কতিপয় সদস্য বিরোধী মত দমনে দলীয় ক্যাডার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গুম, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে বিতর্কিত হয়েছিল এই বাহিনী। এমনকি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এই বাহিনী নৃশংসতা চালিয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। হত্যা-নৃশংসতায় জড়িত থাকায় কয়েক ডজন পুলিশ সদস্য এখন হেফাজতে আছেন। পালিয়ে গেছেন কেউ কেউ।
তবে সেই পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বর্তমানে পুলিশের চেইন অব কমান্ডে আসছে পরিবর্তন। পুলিশ এখন অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক। কিন্তু সেই মানবিক পুলিশকে আবার বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এখন মাঠে মারমুখী হচ্ছেন না। পুলিশ সদস্যরা এখন আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হচ্ছেন না। যে কোনো ইস্যুতে গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর পূর্বের মতো আচারণ করতে দেখা যাচ্ছে না পুলিশ সদস্যদের। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন সময় পুলিশ সদস্যদের ওপর চড়াও হচ্ছেন কতিপয় ব্যক্তি। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের নামে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পুলিশ সদস্যদের ওপর। পুলিশ সদস্যদের গায়ে হাত তোলার অভিযোগও পাওয়া গেছে। পুলিশকে বাধ্য করাতে চাচ্ছে তাদের ওপর লাঠিপেটা করাতে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ সদস্যদের ওপর এই হামলা কি পরিকল্পিত?
দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা সরকারের প্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের মানুষের নিরাপত্তা, জনসেবা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করেন। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা ক্রমাগত হামলা ও মারধরের শিকার হচ্ছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (১১ মার্চ) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে পুলিশের ওপর বাম সংগঠনগুলো হামলা চালায়। এসময় পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি রমনা জোন) মো. আবদুল্লাহ আল মামুনকে লাঞ্ছিত করা হয়। এ ঘটনার পর হামলাকারীরা ওই পুলিশ কর্মকর্তাকেই অভিযুক্ত করে প্রচারণা চালায়। এ ঘটনাকে ‘আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। এর আগে হামলার ঘটনায় রমনা থানার এসআই আবুল খায়ের বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখসহ আরও অজ্ঞাত ৭০ থেকে ৮০ জনকে আসামী করা হয়েছে।
এছাড়াও সম্প্রতি আব্দুর রাজ্জাক ফাহিম নামের এক যুবকের অতর্কিত হামলায় রাজধানীর পল্লবী থানায় ওসি নজরুল ইসলামসহ পুলিশের তিনজন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। এ ছাড়া সম্প্রতি চট্টগ্রাম, সাভার, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, যশোর, মৌলভীবাজারসহ অন্য স্থানে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও হামলা চালিয়ে আসামী ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণে এসব ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসেই পুলিশের কাছ থেকে আসামী ছিনতাইয়ের ১০টি ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও থানায় ঢুকে পুলিশ সদস্যদের শাসানো এবং প্রকাশ্যে পুলিশকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। থানায় ঢুকে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসামী ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাত মাসে পুলিশের ওপর ২৬৭টি হামলার ঘটনায় সমপরিমাণ মামলা হয়েছে। গত বছর আগস্টে ২৪টি, সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪টি, নভেম্বরে ৪৯টি, ডিসেম্বরে ৪৩টি, জানুয়ারিতে ৩৮টি এবং ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরেও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার মধ্যে বেশ কয়েকটির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
হামলার এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের ওপর হামলা মানে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ প্রদর্শন। এতে করে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বিনষ্ট হচ্ছে। কারণ এটি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, বরং আইন ও শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে হামলা। যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করছে, তারা হয়তো স্বল্প মেয়াদে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর খেসারত দিতে হবে দেশের নাগরিকদের। রংপুরে একটি কর্মশালায় আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে মানুষের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। নাগরিক সমাজের প্রতি অনুরোধ, পুলিশকে আপনারা আবার কাছে টেনে নিন। পুলিশকে কাজ করতে সহায়তা করুন। পুলিশকে আবার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে আমরা চেষ্টা করছি যারা অপরাধী (পুলিশ), তাদের বিচারের আওতায় এনে ও সরিয়ে দিয়ে পুলিশকে আবার সগৌরবে ফিরিয়ে আনা, কর্মক্ষম করে তোলা, পুলিশকে আবার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
এদিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে পুলিশের ওপর বাম সংগঠনগুলোর হামলা নিয়ে এসি আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ১১ মার্চ বাম সংগঠনগুলো ‘ধর্ষণ ও নিপীড়ন প্রতিরোধে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়’ অভিমুখে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করে। পুলিশ তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করার জন্য সেখানে উপস্থিত ছিল। কিন্তু, ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বাম সংগঠনের কর্মসূচির একপর্যায়ে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, পুলিশ তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে চলতে সাহায্য করতে চেয়েছিল। আমরা সেখানে একটি ব্যারিকেড স্থাপন করেছিলাম, যাতে তারা নিরাপদে তাদের স্মারকলিপি পৌঁছে দিতে পারেন। আমাদের ডিসি রমনা স্যার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং তারা তাদের কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আলোচনা চলাকালীন হঠাৎ এক ব্যক্তি পুলিশের দিকে থু থু মারতে শুরু করেন। তখন আমি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পেছনে যাই, কারণ আমি সন্দেহ করেছিলাম কোনো আউটসাইডার এসে আন্দোলনকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছে।’ এসি মামুন আরও বলেন, পেছনে গিয়ে আমি দেখতে পাই আরও কিছু ব্যক্তি পুলিশকে লক্ষ্য করে লাঠি ও হেলমেট ছুড়ে মারছে, এমনকি পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে এক ব্যক্তি বড় ইট ছুড়ে মারতে থাকে। আমি তখন তাকে থামানোর চেষ্টা করি। তাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ভাই, ইট মারছেন কেন? এখানে তো আলোচনা হচ্ছে এবং আপনারা স্মারকলিপি দিতে যাচ্ছেন।’ তবে, ঠিক তখনই কয়েকজন আমাকে আক্রমণ করতে শুরু করে। তিনি আরও জানান, এক সাদা পোশাক পরা নারী এবং এক তরুণ আমাকে আক্রমণ করে, যার ফলে আমি আত্মরক্ষার্থে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। আমি বুঝতে পারলাম, তারা সম্ভবত আমাকে টার্গেট করেছিল। একপর্যায়ে আমার মাথায় একটি ঘুষি লাগে, এরপর আমি পড়ে যাই। আমার হাঁটুর চামড়া উঠে যায়। তবে, আমি কোনোভাবেই সঠিক সময়ে রেসকিউ পাওয়ার পর বেঁচে যাই এবং চিকিৎসা নিয়েছি। এসি মামুন আরও বলেন, ‘মিডিয়াতে কিছু ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে যেখানে দাবি করা হচ্ছেÍ আমি সাদা পোশাক পরা ওই নারীর চুল ধরেছি। আমি সবার উদ্দেশ্যে পরিষ্কার করতে চাই, সেই সময় আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ ছিল এবং আমি তাকে থামানোর চেষ্টা করছিলাম। আমি কল্পনাও করতে পারি না, কোনো নারী বা পুরুষের গায়ে আমি হাত তুলবো। ঘটনাক্রমে, ওই সময়ে আমার হাত এক মুহূর্তের জন্য মুষ্টিবদ্ধ ছিল, কিন্তু আমি কোনো অবস্থাতেই তাকে আঘাত করিনি। এসি আবদুল্লাহ আল মামুন ঘটনাটি সম্পর্কে আরও বলেন, ‘আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কাজ করি।
অন্যদিকে পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মো. মতিউর রহমান শেখ এবং সাধারণ সম্পাদক ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে বলেন, ১১ মার্চ বিকেল ৩টার দিকে ধর্ষণবিরোধী পদযাত্রার নামে নারী-পুরুষসহ ৬০-৭০ জনের একটি বিক্ষোভকারী দল প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা অভিমুখে যাত্রার চেষ্টা করে। নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ তাদের পথরোধ করলে তারা লাঠিসোঁটা, ইট-পাটকেল নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করে। হামলায় ডিএমপির রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন গুরুতর আহত হন। এছাড়া আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এ ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম হিসেবে আখ্যায়িত করে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংগঠনটি জানিয়েছে, পুলিশ পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাবে।