তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : মেগাসিটি ঢাকায় নাগরিক সেবা দেয়ার জন্য রয়েছে দুটি সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নামে বিভক্ত এই দুটি সংস্থা থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়ার কথা নাগরিকদের। কিন্তু সেবা মেলেনা। নানা ধরনের সেবা নিতে ঢাকাবাসীকে পড়তে হয় ভোগান্তিতে, বিড়ম্বনায়। ফলে নানা অজুহাতে কোন কোন সেবা পেতে নাগরিকদের অপেক্ষা করতে হয় সপ্তাহ পেরিয়ে মাসাধিককালও। তবে, এর বিপরীত চিত্রও আছে। সেটি কালেভদ্রে ঘটে, সংখ্যায় হাতেগোনা।
অভিযোগে প্রকাশ, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে নাগরিক সেবা দেওয়া হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। জন্ম-মৃত্যু, ওয়ারিশ আর চারিত্রিক সনদ পেতে সময় লাগছে বেশি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও নেই দৃশ্যমান উদ্যোগ। রাস্তা, অলিগলি ও ফ্লাইওভারে পড়ে থাকছে নানা আবর্জনা। দায়িত্ব নিয়ে এসব অপসারণের কেউ নেই। ফলে নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা। সঠিকভাবে সেবা না পাওয়ায় ওয়ার্ডে দায়িত্বরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেবাপ্রার্থীদের বাগবিতণ্ডাসহ হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে।
উত্তরের সেবার চিত্র : গত মঙ্গলবার নাগরিক সেবা নিয়ে কর্পোরেশনের নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নিয়ে এক গণশুনানির আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন-ডিএনসিসি। সেখানে সেবার ধরন উল্লেখ করতে গিয়ে সবার সামনেই ডুঁকরে কেঁদে ওঠেন সাত্তার চৌধুরী নামক এক ব্যক্তি। তিনি জানান, শিক্ষকের মৃত্যু সনদের জন্য সাত হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এছাড়া জন্মনিবন্ধনসহ নানা কাজেও দিতে হয় উৎকোচ। সিটি কর্পোরেশনকে নিয়মিত রাজস্ব দেন তবুও পান না কাক্সিক্ষত সেবা। এমন বঞ্চনার কথা বলতে গিয়েই কাঁদলেন সাত্তার চৌধুরী। তিনি ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। মোল্লারটেক, ইরাশাল এবং আজমপুর নিয়ে গঠিত ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ২০১৮ সালে ডিএনসিসির সঙ্গে যুক্ত হয়।
ওই গণশুনানিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, বাজার কমিটির নেতা, পাড়া মহল্লাভিত্তিক সোসাইটি নেতা এবং যুবক, ছাত্র প্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজন অংশ নেন। তারা রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ-পার্ক, জলাবদ্ধতা, মশার উপদ্রব, সড়কবাতি না থাকা, জন্ম ও মৃত্যু সনদ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের কাছে।
আবদুর সাত্তার চৌধুরী বলেন, ফি নিয়ে একটি জটিলতার কারণে তিন বছর ধরে ট্রেড লাইসেন্স করাতে পারছেন না তিনি। এ বিষয়ে আঞ্চলিক অফিস থেকে কোনো সহযোগিতাও পাচ্ছেন না। তিনি অভিযোগ করেন, জন্ম নিবন্ধন ও মৃত্যু সনদ নিতে চরম হয়রানির শিকার হতে হয় মানুষকে। সম্প্রতি আমার স্কুলের শিক্ষক মারা গেছেন। সেখানে মৃত্যু সনদ আনতে গিয়ে আমাকে সাত হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। জন্মনিবন্ধন করাতে গেলে ফি লেখা আছে ৫০ টাকা বা ১০০ টাকা। কিন্তু আপনি যান, দেখবেন আপনার কাছে ২০০, ৩০০ টাকা চেয়ে বসে থাকে। এসব কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন তিনি।
৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আশরাফুল হক অভিযোগ করেন, সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারীদের কারণে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় হচ্ছে কম। হোল্ডিং ট্যাক্স ঠিকমতো আসছে না, এর মূল কারণ ঘুষ বাণিজ্য। এটা বাংলাদেশের একটা মহা সমস্যা। ঘুষ বাণিজ্যের কারণে আমরা ট্যাক্স দিচ্ছি না। দেখা গেছে ৩ লাখ টাকার ট্যাক্স ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিলে ১ লাখ ২০ হাজার করে দিচ্ছে।
সাদেক আহমেদ রিপন নামের একজন বলেন, আশকোনার মদিনা টাওয়ার থেকে দক্ষিণখান পর্যন্ত আব্বাসিয়া সড়কের একটি অংশ এখনও পানিতে ডুবে থাকে। পানি এত নোংরা যে লোকজন নামাজ পড়তে যেতে পারছে না, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে, প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। দক্ষিণখানের কোথাও কোনো পানি নাই। কিন্তু আমাদের ওই রাস্তা এখনও পানির নিচে। বর্ষার আগেই আমাদের ওই সড়কে বর্ষা চলছে। আমরা চাই ওই রাস্তাটি চলাচলযোগ্য করা হোক।
গণশুনানিতে ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ায় ডিএনসিসির আকার বেড়েছে, কিন্তু লোকবল না বেড়ে আগের চেয়ে বরং কমেছে। এতে কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পারছেন না তারা।
সামগ্রিক চিত্র : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এই দুই সিটি কর্পোরেশনের জনসেবার বিষয়গুলো দেখতেন স্ব-স্ব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা। সেই সুযোগ এখন আর নেই। কারণ একাধিক ওয়ার্ডের জনসেবার বিষয়গুলো দেখছেন সিটি কর্পোরেশনের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা)। একজন আঞ্চলিক কর্মকর্তাকে ৭-৯টি সাধারণ ওয়ার্ড ও তিনটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হচ্ছে। অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ তো রয়েছেই। একাধিক কাউন্সিলরের দায়িত্ব একজন কর্মকর্তার ওপরে পড়ায় তিনি সামাল দিতে পারছেন না। ফলে বেড়েছে জনভোগান্তি।
ঢাকা উত্তর সিটির অধীনে ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। আর দক্ষিণে রয়েছে ৭৫টি ওয়ার্ড। সরকার পতনের আগে প্রতিটি ওয়ার্ডে নাগরিক সেবায় একজন কাউন্সিলর ছিলেন। এর সঙ্গে উত্তরে ১৮ জন এবং দক্ষিণে ২৫ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর যুক্ত ছিলেন। সিটি কর্পোরেশনের সাত থেকে আটটি ওয়ার্ড মিলে একটি আঞ্চলিক নির্বাহী অফিস। সেখানে একজন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োজিত। এভাবে উত্তর সিটিতে ৫৪টি ওয়ার্ডের জন্য ১০ জন, দক্ষিণে ৭৫টি ওয়ার্ড হলেও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ১০ জন দিয়ে চলছে সিটি কর্পোরেশনের কাজ। ফলে কাজের গতি কমে যায়, মাঠপর্যায়ের মনিটরিং ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে।
মেয়র ও কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতির কারণে প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে জন্মসনদ, নাগরিকত্বের সনদ, মৃত্যুসনদ, চারিত্রিক সনদ, উত্তরাধিকারী সনদ, আয়-ব্যয়, পারিবারিক সদস্য, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সনদ, বিভিন্ন প্রত্যয়ন, অনাপত্তিপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় যাচাইকারী হিসেবে স্বাক্ষর করতে হয়।
সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, জন্ম-মৃত্যু ও নাগরিকত্ব সনদ পাওয়া এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। নানা ধাপ পেরিয়ে একটি জন্মসনদ নিতে ১০-১২ দিনের বেশি লেগে যাচ্ছে। ফলে সেবাগ্রহীতার ভিড় লেগেই থাকে। বেশির ভাগই আসেন সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে। কিন্তু কার্যালয় তালাবদ্ধ দেখে ওয়ার্ড সচিবকে খোঁজেন তারা। না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। পরে হতাশ হয়ে চলে যান। সচিবদের পেলেও নানা ধরনের সমস্যা দেখিয়ে ফিরিয়ে দেন সেবাপ্রার্থীদের। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডা লেগেই থাকে।
গত বছরে শেষ দিকে উত্তর সিটির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সেবাপ্রার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে (পল্লবী) সচিব শামিউল ইসলাম শিশিরকে মারধর করেন। ওই ঘটনার পর শিশির ওয়ার্ড সচিবের দায়িত্ব পালনে অপারগতা জানান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের কাজ এখন সচিবরা করছেন। তবে কিছু কাজ সচিবদের জন্য সময়সাপেক্ষ। আগে কাউন্সিলররা যেমন চাইলে একটি স্বাক্ষর করে দিতেন। তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের পরিচিতির একটা ব্যাপার ছিল। এখন সচিবরা যাচাই না করে স্বাক্ষর দিলে বড় ধরনের ভুল হতে পারে। যার ভুক্তভোগী আপনি, আমি-আমরা সবাই হতে পারি। কাউন্সিলররা আবার এলে এসব বিষয় ঠিক হতে পারে।