রাজধানী
ছাত্র-জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা
শহীদ হাফেজ মঈনুলের ঘাতকদের কঠিন বিচার চান মা বাবা
২৬ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার। ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকার রাস্তাগুলো ছিল উত্তাল, মানুষের কণ্ঠে প্রতিবাদের বজ্রধ্বনি। সেদিন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সাহসী শহীদ হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলাম। যাত্রাবাড়ি এলাকায়
Printed Edition

২৬ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার। ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকার রাস্তাগুলো ছিল উত্তাল, মানুষের কণ্ঠে প্রতিবাদের বজ্রধ্বনি। সেদিন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সাহসী শহীদ হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলাম। যাত্রাবাড়ি এলাকায় গণঅভ্যুত্থানের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলীতে নিহত হন মুগদা দারুল উলুমের এই শিক্ষার্থী। শহীদ মাওলানা মঈনুল ইসলামের আত্মত্যাগের গল্প কোনো গণমাধ্যমে আসেনি। উঠে আসেনি কোনো বইয়ের পাতায় কিংবা কোনো তালিকায়। তবুও এই হাফেজ শহীদের আত্মত্যাগ গণঅভ্যুত্থানের সংগ্রামী ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জুলাই বিপ্লবে শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলামকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। সে আমার সব ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এখন আমি কী আশা নিয়ে বাঁচব? আমি আমার সন্তান হারানোর বিচার চাই। যারা আমার সন্তানকে গুলী করেছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। তবে দুনিয়ায় বিচার না পেলেও, আল্লাহর কাছে বিচার চাই। আল্লাহ এর বিচার করবে। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলামের মা মাহফুজা বেগম। ২০২৪ সালের ২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলীবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুলাই রাতে শহীদ হন হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলাম।
গোপালগঞ্জের কেকানিয়া গ্রামে ১৯৯৯ সালের ২৮ অক্টোবর জন্ম নেওয়া মাওলানা মঈনুল ইসলামের ধর্মীয় জ্ঞান ও সততা ছিল তার পরিচয়ের মূল স্তম্ভ। তার পিতা হাফেজ কামরুল ইসলাম একজন আলেম হিসেবে স্থানীয়ভাবে সম্মানিত ছিলেন। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার শুকতাইল ইউনিয়নের কেকানিয়া গ্রামের কামরুল ইসলাম ও মাহফুজা বেগম দম্পতির বড় সন্তান হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলাম (২৫)। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকার আহসানুল হিকমাহ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন তিনি।
যেভাবে শহীদ হন : জুলাই বিপ্লবে শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলামের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২১ জুলাই ২০২৪ দুপুরে বাসা থেকে মাদ্রাসায় যাচ্ছিলেন মঈনুল। এ সময় ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। ওপর থেকে ছোড়া গুলী হাফেজ মাওলানা মঈনুলের ঘাড়ে লেগে আহত হন তিনি। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। পাঁচ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ২৬ জুলাই ২০২৪ রাতে সেখানে মারা যান। জানাযা শেষে মঈনুলের লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। জুলাই বিপ্লবে শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলামের বাবা কামরুল ইসলাম ফরিদপুরের পূর্ব খাবাসপুর জামে মসজিদে মোয়াজ্জিনের চাকরি করেন। মা মাহফুজা বেগম গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলাম ছিলেন সবার বড়। শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলামের ছোট দুই ভাই মোস্তাফিজুর রহমান ও মাহমুদুল হাসান। তারা মাদারীপুরের শিবচর মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। ছেলেদের মধ্যে মঈনুল ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম। জুলাই বিপ্লবে শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলামকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন তার বাবা-মা ও ভাই-বোন।
শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলামের বাবা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন আমি আসরের নামায শেষ করে দেখি আমার মোবাইল ফোনে একটি মিসকল। আমি ওই নম্বরে কল করলে এক ব্যক্তি ধরে বলেন, আপনার ছেলে গুলীবিদ্ধ হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে। আমি শুনে মাথা ঘুরে পড়ে যাই। আমার ইমাম সাহেব আমাকে টেনে উঠায়। পরে আমি হাঁটা শুরু করলে সবাই আমাকে নিষেধ করেন। বলেন, আপনি এ পরিস্থিতির মধ্যে বের হবেন না। কোথায় গুলী খাবেন, কে জানে? তবুও আমি কোনো কথা না শুনে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে ঢাকাগামী ফেরি পারাপারের একটি অ্যাম্বুলেন্স পাই। সেটিতে উঠে রাত ২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে দেখি আমার ছেলে মঈনুলের শরীর দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। খালি গায়ে শীতে কাঁপছে। দোকান থেকে একটি কম্বল কিনে এনে গায়ে দেই। পাঁচ দিন পরে সে মারা যায়। মঈনুলের বাবা আরও বলেন, মঈনুল আমার সংসারের অভাব-অনটন দূর করবে। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম। একটি গুলী আমার সব স্বপ্ন কেড়ে নিল। আমি সন্তান হারিয়েছি, আমি জানি সন্তান হারানোর কত কষ্ট। কেউ যেন আমার মতো সন্তানহারা না হয়। তিনি সঠিক তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অনেক কষ্টে শহীদের লাশ বুঝে পায় তার পরিবার।
জামায়াতের পক্ষ থেকে অনুদান প্রদান: শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলামের পরিবারকে জেলা জামায়াতের পক্ষ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তার স্ত্রী মাইমুনা আক্তারকে দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা।
হাফেজ মঈনুল ইসলামের শহীদ হওয়ার পর পরিবারের অভিব্যক্তি: শহীদ হাফেজ মাওলানা মঈনুলের ছোট ভাই মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। ভাই আমাদের দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাত। এখন আমাদের লেখাপড়ার টাকা দেবে কে? আমার ভাইকে যারা গুলী করে হত্যা করেছে তাদের কঠিন বিচার চাই।
মা মাহফুজা বেগম বলেন, আমার ছেলেদের মধ্যে হাফেজ মঈনুল একমাত্র উপার্জনকারী ছিল। অভাবের সংসার। তাই অনেক কষ্ট করে বাড়িতে টাকা পাঠাত। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক টাকার মালিক হয়ে আমার সব স্বপ্ন পূরণ করবে। আমার মঈনুল ঘরের কাজ করা দেখে গেছে। কিন্তু ঘরটি সম্পন্ন করা দেখে যেতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে রুটি-গোশত খুব পছন্দ করত। বাড়ি আসলে রুটি বানানোর সময় আমার পাশে বসে পেট ভরে রুটি খেত। যাওয়ার সময় টিফিনবক্স ভরে রুটি দিতাম। এখন আমি কাকে রুটি বানিয়ে দেব? আমার ছেলেকে যারা কেড়ে নিয়েছে, তাদের বিচার আমি দেখে মরতে চাই। দুনিয়ায় বিচার না পেলে আল্লাহ যেন বিচার করেন। আল্লাহ আমার ছেলেকে শহীদি মর্যাদা দান করুক। মা হয়ে এছাড়া আর কিছু আমার বলার নেই।