রাজধানী
ফারাক্কায় প্রবাহ কম ॥ উজানেই প্রত্যাহার হয় ৯০ ভাগ
এবারেও গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ!
বাংলাদেশ এবারেও গঙ্গার পানির নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে! শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই ফারাক্কার ভারতীয় অংশে পানির প্রবাহ কম থাকায় বাংলাদেশের ভাগ্যে পানি জুটবে না। এই প্রবাহ কম থাকার মূল কারণ উজানেই ৯০ ভাগ পানি প্রত্যাহার করে নেয়া।
Printed Edition
সরদার আবদুর রহমান : বাংলাদেশ এবারেও গঙ্গার পানির নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে! শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই ফারাক্কার ভারতীয় অংশে পানির প্রবাহ কম থাকায় বাংলাদেশের ভাগ্যে পানি জুটবে না। এই প্রবাহ কম থাকার মূল কারণ উজানেই ৯০ ভাগ পানি প্রত্যাহার করে নেয়া।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন-জেআরসি’র নিয়ম রক্ষার বৈঠক চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ‘সবকিছু ঠিক আছে’ বলা হলেও এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে ‘এবার ফারাক্কায় পানির পরিমাণ কম।’ অর্থাৎ নিয়ম মেনে পানির ভাগাভাগি ঠিক থাকলেও পানি ‘কম’ থাকায় বাংলাদেশ তার নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিতই থাকছে। তবে এই পানি-প্রবাহ কম থাকার মূল কারণ ‘উজানে ব্যাপক হারে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার’ বিষয়টি উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকে ভারতীয় পক্ষ।
সূত্র জানায়, জেআরসি’র প্রতিনিধি দলের সদস্যরা মঙ্গলবার ফারাক্কা ব্যারেজ পরিদর্শন করেন। পানিবণ্টন চুক্তি অনুসারে এই মুহূর্তে সেখানে কতটা পানি রয়েছে, চুক্তিমত বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। পরিদর্শনে ছিলেন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য আবুল হাসান এবং ফারাক্কার ব্যারেজ প্রজেক্টের জেনারেল ম্যানেজার আরডি দেশপান্ডে। উল্লেখ্য, ভারত-বাংলাদেশ পানিবণ্টন চুক্তি শেষ হচ্ছে আগামী বছরে। ঠিক তার আগেই চুক্তি পুনরায় নবায়নের বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং পানিবণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক অভাব-অভিযোগ এবং সার্বিক বিষয় নিয়ে বৈঠক করতে ভারতে যান বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। দুদেশের যৌথ নদী কমিশনের ৮৬তম এই বৈঠক চলে গতকাল ৮ মার্চ পর্যন্ত। এই বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও ভারতীয় গণমাধ্যমকে বাংলাদেশের আবুল হাসান বলেন, “জানুয়ারি মাসে পানি নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। দু’দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই চুক্তি নবায়ন হবে বলেই মনে করছি।” আর বাংলাদেশের একটি পত্রিকাকে তিনি এও বলেন, “এবার গঙ্গার পানি প্রবাহ কম সে বিষয়টি আমরা শুধু তাদের জানিয়েছি। গঙ্গা চুক্তি নবায়ন নিয়ে একটি নতুন যৌথ কমিটি হবে, সেই যৌথ কমিটি গঙ্গা চুক্তি নবায়ন নিয়ে আলোচনা করবে।”
নয়া পটভূমিতে চুক্তি নবায়ন
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর করা ৩০ বছরের এই চুক্তি ২০২৬ সালের ১২ ডিসেম্বর শেষ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে গত আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে টানাপোড়েন চলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি দেশের সরকার পরিবর্তন হতেই পারে এবং সেটি সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই পরিবর্তনের বিষয়টি ভারতীয় পক্ষ এখন পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতির উন্নতির উপর আগামী চুক্তির অনেকটাই নির্ভর করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বরাবর অভিযোগ আছে। চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গা নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক। আর ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি পানি থাকলে ৪০ হাজার কিউসেক পাবে ভারত, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তিতে পানি বণ্টনের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা থাকলেও সেটি ঠিকমত মানছে না ভারত। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অন্যায়ভাবে অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ-পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়।
ফারাক্কা পয়েন্টে পানি থাকে না
বাংলাদেশের পদ্মায় পানি না আসার প্রধান কারণ ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি জমা না হওয়া। এর মূলে রয়েছে উজানে গঙ্গার পানি ইচ্ছেমত প্রত্যাহার করা। অসংখ্য প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে পদ্মায় পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টির পাশাপাশি বিভিন্ন কৃত্রিম খাল-ক্যানেল দিয়ে পানি সরিয়ে নিয়ে উজানের বিভিন্ন প্রকল্পে সেই পানি কাজে লাগানো। ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ফারাক্কার কাছাকাছি যে প্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভাগীরথী নদীর উপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলি ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া। ভারত তার বহু সংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ। এছাড়াও নদীসদৃশ বেশ কয়েকটি ক্যানেল প্রকল্প দিয়েও সারা বছর পানি প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে। ভারত নদীসদৃশ ৭টি ক্যানেল বা কৃত্রিম খাল প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কিউসেক পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নিয়ে কয়েক লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করছে। তারা অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল (ক্যানেল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল ২য় পর্যায়’ এবং ‘সমান্তরাল নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল’। এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে।