মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ অন্যান্য অপকর্ম বন্ধ করতে না পারলে দলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এসব বন্ধে নানা উদ্যোগ নিলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন সেভাবে হচ্ছে না। প্রায় সাত বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপির বর্ধিত সভায় সারাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন জেলা, মহানগর ও থানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের সামনে এসব কথা বলেন। তারা বলেন, এখন অনেককেই দেখা যায় সামনের কাতারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু দলের দু:সময়ে তাদের দেখা যায়নি। এভাবে চলতে থাকলে দলের নেতৃত্ব ও ঐক্য বাধাগ্রস্থ হবে। নেতৃবৃন্দ বলেন, ভবিষ্যতে যাতে ব্যক্তি পছন্দে নেতা নির্বাচন কিংবা টাকার জোরে মনোনয়ন না পান সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। তারা মসজিদে-মাদরাসায় সভা করছে। আর বিএনপি চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অনৈক্যে বিভক্ত। এসব বন্ধ করতে হবে। দল ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে মন্তব্য করে কেউকেউ নিজেদের মধ্যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য ধরে রাখার কথা বলেছেন। তারা বলছেন, ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদ সরকার পালিয়ে গেলেও এখনো তার দোসররা রয়ে গেছে।

সকাল ১০টায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল ভবন সংলগ্ন মাঠে বিএনপির বর্ধিত সভা শুরু হয়। এটিকে কেন্দ্র করে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দূর দূরান্ত থেকে আসা নেতারা আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে সভাস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করেন। সংসদ ভবনের প্রবেশমুখে অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যরা গোলাপ-রজনী গন্ধার ফুলের গুচ্ছ দিয়ে নেতৃবৃন্দকে শুভেচ্ছা জানায়। আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া বর্ধিত সভায় প্রবেশে কড়াকড়ি থাকায় বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক সংসদ ভবনের অবস্থান নেয়।

এলডি ভবনের সামনের মাঠে স্টিল অবকাঠামো দিয়ে তৈরি করা হয় সুসজ্জিত বৃহৎ প্যান্ডেল ঘেরা উন্মুক্ত মিলনায়তন। বর্ধিত সভার মূল মঞ্চে বড় পর্দায় লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিভাবে শুরু হয় বিএনপির বর্ধিত সভার কাযর্ক্রম। তিনি সভাপতির আসন গ্রহন করেন।

এরপর ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনে এবং ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নিহতদের স্মরণে একমিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করেন নেতৃবৃন্দ। এরপর শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। উদ্বোধনী পর্বে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাগত বক্তব্য রাখে। অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতার বিপ্লব পর্যন্ত দলের কাযর্ক্রমের ওপর তৈরি করা ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। সভাপতির স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মধ্যাহ্ন ভোজের কিছুটা আগে শুরু হয় রুদ্ধদ্বার কর্ম অধিবেশন। এই অধিবেশন তৃণমূল নেতারা সাংগঠনিক এবং বর্তমান পরিস্থিতির ওপর বক্তব্য রাখেন।

বর্ধিত সভার মূল মঞ্চে বিএনপির মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বসেন। ভার্চুয়ালি লন্ডন থেকে যুক্ত হন স্থায়ী কমিটির সদস্য এজেডএম জাহিদ হোসেন।

মঞ্চের এক পাশে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। মঞ্চে বড় পর্দায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছিলেন। সভাটি সঞ্চালন করেন দলের যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানী ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। রাত অবধি চলা টানা এই বর্ধিত সভা উপলক্ষে অতিথিদের জন্য সকালের নাস্তা, দুপুরে খাবার, বিকালে স্ন্যাকের ব্যবস্থা রাখা ছিল। বর্ধিত সভা উপলক্ষে সংসদ ভবনের প্রাচীরের বাইরে বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচিগুলো বড় প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

বর্ধিত সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে দলের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন নেতারা। এবার লটারির মাধ্যমে বক্তব্যদাতাদের আহবান করা হয়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থানা, উপজেলা ও পৌরসভার নেতারা তিন মিনিট করে বক্তব্য রাখেন। সন্ধ্যার পর জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। এরপর দলের ভাইস চেয়ারম্যানসহ সিনিয়র নেতারা বক্তব্য রাখেন। সবশেষে দিক নির্দেশনামূলক রাখেন সভার সভাপতি ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

অনুষ্ঠানে পাবনা জেলার সাথিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুন নাহার খানম বলেন, চিরস্থায়ীভাবে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখতে এখনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে বর্ধিত সভা নয়, বিভাগীয় পর্যায়ের সম্মেলন করতে হবে। সেখানে তৃণমূলের কষ্টের কথা জানতে হবে। সারাদেশে বিএনপি কার্যালয় ভিত্তিক রাজনীতি করলেও এখন তাদের প্রতিপক্ষ একটি দল (জামায়াত) মসজিদ ভিত্তিক রাজনীতি করছে। এই মসজিদ ভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকবে কি না তা এই অন্তর্বর্তী সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। প্রতিপক্ষ ওই দলটি বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক গুজব, অপপ্রচার করছে। সেটার জন্য দলকে কাউন্টার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়োর নেতা হুমায়ুন কবির বলেন, জামায়াতকে মোকাবেলায় সকালে মসজিদে নামাজ পড়তে হবে। দলকে এগিয়ে নিতে হলে ত্যাগীরা পিছিয়ে থাকবে না, মওসুমি নেতারা এগিয়ে যাবে না- এমন কৌশলে এগোতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সরকারের গঠিত কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে তার বিরোধীতা করে তিনি বলেন, ইউপি মেম্বরদের ভোটে চেয়ারম্যান নয়, জনগণের ভোটে চেয়ারম্যান না হলে জনগণের কাছে ওইসব জনপ্রতিনিধি দায়ভার নেবে না। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনভাবেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে তিনি জানান।

খুলনা সদর থানা বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, একটি গুপ্ত সংগঠন সারাদেশে মব সৃষ্টি করছে, অরাজকতা করছে, বিএনপিকে নিয়ে গুজব সৃষ্টি করছে। এই দলটি বিগত ১৬ বছর বিএনপির সঙ্গে থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন করলেও এখন তারা সুবিধাজনক সময়ে আওয়ামী লীগের দোসরদের প্রতিষ্ঠা করছে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আাঁতাত করছে।

টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকার নেতা জাকির হোসেন সরকার বলেন, শেখ হাসিনা যদি বিএনপিকে ধ্বংসই করতে পারতো তাহলে আজ বিজয় আসতো না। বিগত দিনে যে আওয়ামী লীগ এত অত্যাচার করেছে এখন সেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলের কতিপয় নেতাকর্মী প্রশ্রয় দিচ্ছেন, মদদ দিচ্ছেন। যারা গত ১৫ বছর ছিল না তারা এখন আমাদের ঘরে ঢুকে ঐক্য বিনষ্ট করতে চাচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

নওগার মহাদেবপুর এলাকার নেতা রবিউল আলম বলেন, ৫ আগষ্টের পর এখন অনেক নেতাকর্মী দেখা যাচ্ছে। যাদেরকে বিগত আন্দোলনে দেখা যায়নি। সুবিধা ভোগি নেতাকর্মীদের ভিড় দেখে মনে হচ্ছে- আমরাই এখন দলে সংখ্যালঘু।

হবিগঞ্জের সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিগত দিনে যারা গর্তে লুকিয়ে ছিলো, আওয়ামী লীগের সাথে আতাত করেছিলো তাদের এখন আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। এই সুবিধাভোগিদের কাছে ত্যাগীরা হারিয়ে গেলে পুরো বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দলের দুর্দিনে তৃণমূল বেইমানি করেনি। যে কোন সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। অথচ এক শ্রেণীর মৌসুমি নেতা সুবিধা নিয়ে মোটাতাজা হয়েছে। আর ত্যাগীরা হয়েছেন স্বাস্থ্যহীন। এই ত্যাগীরা দলের হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।

সৈয়দপুর জেলা বিএনপি নেতা আলমগীর মাতুব্বর বলেন, যারা আমাদের বাড়ি-ঘর ভেঙে দিয়েছে। তারাই আজ বিএনপির প্রথম কাতারে। এই হাইব্রিড যেনো বিএনপি না ঢুকে।

জামালপুর জেলা বিএনপি নেতা আতিকুর রহমান সাজু বলেন, জুলাই-আগস্টে যারা আন্দোলন করেছে তারা আমাদেরই সন্তান। তারা আওয়ামী লীগের দোসরদের কেউ নয়। তাই ছাত্রদের পড়ার টেবিলে ফিরে যাওয়া উচিত। আর দেশে এখন ষড়যন্ত্র চলছে। এজন্য বিএনপির কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগঠনকে চাঙা করতে হবে।

জামালপুর জেলা বিএনপি নেতা জহিরুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ৫ আগস্টের সপর নব্য বিএনপি হয়েছে। তাদের জন্যই বিএনপির এই বেহাল দশা। আর মসজিদ ও মাদরাসার কমিটি নিয়ে ঝগড়া হয়, এগুলো থেকে সরে আসতে হবে।

ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপি নেতা জিয়াউল ইসলাম জিয়া বলেন, দেশে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে। সুতরাং আপনি (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান) নিজস্ব সেল ও জরিপের মাধ্যমে মনোনয়ন দেবেন। তাকেই মনোনয়ন দেবেন যার অবস্থান সবচেয়ে ভালো হবে। আর যারা দলের ক্ষতি করবে গোপন সেল করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।

ভোলা জেলা বিএনপি নেতা মো. মফিজুর রহমান মিলন বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর বিএনপিতে কোন সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না। বিএনপি যাতে আওয়ামী লীগের দোসরদের জায়গা না হয়।

যশোর জেলা বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, প্রত্যেক জায়গায় হাইব্রিড ও গ্রুপিং রয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে গ্রুপিং দূর করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএনপিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিতে হবে।

দিনাজপুর জেলা বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম মিলন বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলকে শক্তিশালী করতে হবে। ৫ আগস্টের পরে বিএনপির ভিতরে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। ত্যাগীদের কোণঠাসা ও বহিষ্কার করা হচ্ছে। পদ স্থগিত করা হচ্ছে। তাদের পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। তৃণমূলকে জাগাতে হবে, হাইব্রিডদের ঠেকাতে হবে।

নোয়াখালী জেলা বিএনপির নেতা দেওয়ান শামসুল আরেফিন শামীম বলেন, বিগত ১৭ বছরে আন্দোলন-সংগ্রামে যাদের ডেকে পাইনি, তাদেরকে দলে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে দায়িত্ব দিলে আগামীতে তারা দলের সঙ্গে বেইমানি করবেন।

কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির নেতা জাহিদুল ইসলাম বিপ্লব বলেন, আমরা অনেক মামলা-হামলার স্বীকার হয়েছি। দলের দুঃসময়ে যারা ছিলেন না, তারা এখন বিএনপিতে ভালো জায়গায় আছেন।

নীলফামারী জেলা বিএনপির নেতা মাসুদ চৌধুরী বলেন, দলের ভিতরে এখন বিশৃঙ্খলা দেখতে পাচ্ছি। কিছু সুবিধাবাদী দেখতে পাচ্ছি। এসব সুবিধারা ত্যাগিদের বিতাড়িত করতে চায়। দলের অনেক নেতা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এই ত্যাগীদের কথা যাতে আমরা ভুলে না যাই। পাশাপাশি বর্ধিত সভায় মত করে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সভা করারও পরামর্শ দেন তারা।

এদিকে বর্ধিত সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, একটি মহল, একটি গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে তা রুখে দিতে চক্রান্ত শুরু করেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিদেশে গিয়ে সেই চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, যারা আমাদের দলের সুনাম ক্ষুন্ন করবে এবং আমাদের যাত্রাকে ব্যাহত করবে, তাদের ছাড় দেয়া হবে না।