মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এই রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তার আইনজীবী শিশির মনির।

গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন।

শিশির মনির বলেন, আমরা মনে করি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অতীতের অনেক রায় সম্পর্কে এই রায়ে অনেক পর্যবেক্ষণ থাকবে। আমরা মনে করি সরকারের উচিত হবে- এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পরে একটা রিভিউ বোর্ড গঠন করে অতীতের রায়গুলোকে পুনর্বিবেচনা করা, যেন মৃত্যু পরবর্তীতে হলেও যাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে, তাদের পরিবার, তাদের দল এবং এদেশের মানুষ যেন ন্যায় বিচার পেতে পারে।

তিনি বলেন, আজকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এটিএম আজহারুল ইসলামকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। আজকে থেকে, এখন থেকে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম একজন নির্দোষ ব্যক্তি। এই রায়ের মাধ্যমে আমরা মনে করি সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। ইতোপূর্বে জামায়াতের এবং বিএনপির ছয়জন শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্ততপক্ষে পাঁচজন জেলে মৃত্যুবরণ করেছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন নির্যাতনের সামিল। এটিএম আজহারুল ইসলাম সৌভাগ্যবান, তিনি ন্যায় বিচার পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বলে। আমরা মনে করি এ রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান হয়েছে। আমরা এটাও মনে করি- এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।

শিশির মনির জানান, আজকে (মঙ্গলবার) রায়ে আদালত চারটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এগুলো হলো-

১। মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে অতীতের রায়গুলোতে বাংলাদেশসহ এই সাবকন্টিনেন্টে ক্রিমিনাল বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি চেইঞ্জ করে দেয়া হয়েছিল, এটা ছিল সবচাইতে বড় ভুল।

২। আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমাণ অ্যাসেসমেন্ট তথা পর্যালোচনা করা ছাড়াই এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেবকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

৩। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি ট্রাভেস্টি অব ট্রুথ (ঃৎধাবংঃু ড়ভ ঃৎঁঃয) অর্থাৎ বিচারের নামে অবিচার।

৪। যে সব তথ্য প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

শিশির মনির বলেন, ফলশ্রুতিতে আজকে এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে। আমরা মনে করি এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সত্য বিজয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাভূত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আমরা আদালতের কাছে একটা সংক্ষিপ্ত আদেশ চেয়েছি। আদালত আমাদের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আদালত বলেছেন, আমরা চেষ্টা করব। আজকে এবং কালকের মধ্যেই এই সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রস্তুত হয়ে এ টি এম আজহারুল ইসলাম যেন মুক্তি পেতে পারেন সেই জন্য সব আইনি ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব।’

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, আমরা মনে করি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অতীতের অনেক রায় সম্পর্কে এই রায়ে অনেক পর্যবেক্ষণ থাকবে। আমরা মনে করি সরকারের উচিত হবে- এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পরে একটা রিভিউ বোর্ড গঠন করে অতীতের রায়গুলোকে পুনর্বিবেচনা করা, যেন মৃত্যু পরবর্তীতে হলেও যাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে, তাদের পরিবার, তাদের দল এবং এদেশের মানুষ যেন ন্যায় বিচার পেতে পারে।

এদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়কে মেনে নিয়েছে প্রসিকিউশন। গতকাল রায় ঘোষণার পর হাইকোর্টের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আজ (মঙ্গলবার) এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার রায়ের দিন ধার্য ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমরা রায় গ্রহণের জন্য আপিল বিভাগে উপস্থিত ছিলাম। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোনো রায়ের ব্যাপারে মন্তব্য করাকে আমি আইনসিদ্ধ মনে করি না। তবে আমরা শুনানিতে যে প্রসঙ্গে কথা বলেছিলাম, এই রায়ে আমরা তারই প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি।

গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, এটিএম আজহারুল ইসলামের পক্ষে তাদের যে মূল সাবমিশনটা ছিল, সেটি হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে জাজমেন্ট ৫ আগস্টের আগে হয়েছে, সেগুলোতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা ছিল না। আপিল বিভাগও এটিকে অ্যাফার্ম করেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা প্রয়োজন নেই। এই যুক্তিতর্কের ব্যাপারে প্রসিকিউশন প্রথম থেকেই বলেছে, এই যুক্তিতর্কের ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এখানে আন্তর্জাতিক আইনের ডেফিনেশন অব ক্রাইমস এবং মুডস অব লাইবেলিটির প্রযোজ্যতা প্রয়োজন। তা না হলে আমরা যে সমালোচনা আগে ট্রাইব্যুনালের রায়ের ক্ষেত্রে করেছি, এটি আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী নয়, সেটি বহাল রয়ে যায়। এজন্য আমরা আপিল বিভাগে সাবমিশন রেখেছিলাম, আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা প্রয়োজন। এটি যে প্রসিকিউশন এবং বর্তমান সরকার চায়, তার প্রমাণ হলো আমরা প্রসিকিউশনে যোগদানের পর পরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ কে সংশোধন করে আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এজন্য আপিল বিভাগ যখন বলেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা প্রয়োজন, এই ব্যাপারে আমাদের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এখনো একমত পোষণ করছি এবং এই রায়ের পক্ষে এখনো কথা বলছি।

তিনি আরও বলেন, আজহারুলের মামলায় যে মেরিটগুলো ছিল, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা আপিল বিভাগে বলেছিলাম, এটি আপ টু ইউর লর্ডশিপ ডিসিশন। লর্ডশিপ এই মেরিট বিবেচনায় এটিএম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়েছেন। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রায়কে আমরা মেনে নিয়েছি এবং আমরা এটি মেনে নিতে বাধ্য।

এর আগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেন।