মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে রায় ঘোষণার জন্য আগামী ২৭ মে দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এ দিন ধার্য করন। আপিলের শুনানিতে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের রায়গুলো যে সাজানো ও পরিকল্পিত ছিল এস কে সিনহার বই তার প্রমাণ।

আদালতে এটিএম আজহারের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট রায়হান উদ্দিন, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, এডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলালসহ শতাধিক আইনজীবী।

জামায়াত নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল, নায়েবে আমীর ড. হেলাল উদ্দিনসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।

এর আগে, বুধবার আপিলের প্রথম দিনের শুনানি শেষ হয়। পরবর্তী শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এ দিন ধার্য করেন।

পরে শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আগামী ৭ মে রায় প্রচারের জন্য দিন ধার্য্য করেছেন। আমরা আদালতে বলেছি, জনাব এটিএম আজহারুল ইসলামসহ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, জনাব কামারুজ্জামান, জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জনাব মীর কাশেম আলী, জনাব সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী সকলেই সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিজের শিকার হয়েছেন। কাদের মোল্লাসহ সকলেই একটি সংঘবদ্ধ অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয়েছেন। এই সিন্ডিকেট কারা ছিলেন, কিভাবে ছিলেন তা আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি। আমরা একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী যা তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন সেটা আদালতে উপস্থাপন করেছি। আমরা মনে করি এ রায়ের মাধ্যমে, যদি এটিএম আজহারুল ইসলামকে বিজ্ঞ আদালত খালাস প্রদান করেন, তাহলে জুডিশিয়্যাল কিলিংএর যে নমুনা এদেশে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এ কলঙ্ক থেকে বিচার বিভাগ আংশিক হলেও মুক্ত হবেন। আমরা আশা করি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস প্রদান করবেন।

তিনি বলেন, আমরা এটাও মনে করি, নজিরবিহীন নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পার করেছে, এ রায়ের মধ্য দিয়ে সকলের মধ্যে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করবে। এভাবে বিচার বিভাগীয় কলঙ্কের মাধ্যমে কোন একটা রাজনৈতিক দলকে অন্যায় অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার করা যায়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তারই একটি উদাহরণ। কিন্তু যারা এই নির্যাতন নিপীড়ন করেছেন, নেতাদের হত্যা করেছেন, ফাঁসি দিয়েছেন, আয়না ঘর বানিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তাদের শেষ রক্ষা হয় নাই। এখান থেকে সকলেই শিক্ষা নেয়ার বিষয় আছে। সকলকে এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে, নির্যাতন ও নিপীড়নের রাস্তা শেষ পর্যন্ত ভালো ফল বয়ে আনে না।

তিনি বলেন, এটাও আদালতকে বলেছি, আজহারুল ইসলাম সাহেবের তখন বয়স ছিল ১৮ বছর। ১৮ বছরের একজন ছাত্রকে তারা কমান্ডার বানিয়ে সাজা দিয়েছেন, যেখানে ট্রাইব্যুনাল তাকে কমান্ডার হিসেবে উল্লেখ করেন নাই, সেখানে আপিল বিভাগ নিজ উদ্যোগে কামন্ডার হিসেবে উল্লেখ করে ধারা ৪(২) এ মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। আরো মজার বিষয়, আইনে যে জেরা করার সুযোগ ছিল, সে সুযোগটি আপিল বিভাগ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমরা কন্ট্রাডিকশান নিতে পারতাম না।

শিশির মনির বলেন, ৬ কিলোমিটার থেকে দেখছে, ৩ কিলোমিটার দূর থেকে দেখেছে এ ধরনের অবিশ্বাস্য সাক্ষ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে এটিএম আজহারুল ইসলামকে সাজা প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিচারপতি জিনাত আরা এসমস্ত অন্যায়ের বিচারিক প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সেই বিচারিক প্রতিবাদ তখন শোনার কেউ ছিল না। আল্লাহ এটিএম আজহারুল ইসলামকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এটি আল্লাহর পরিকল্পনা। আল্লাহর পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে আমরা যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছি। তারা যদি মনে করতো এটিএম আজহারুল ইসলামকেও ফাঁসি দিতে পারতো। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনার উপর তারা হাত দিতে পারে নাই। এ কারণে আগামী ২৭ তারিখ যে রায় হবে, আমরা আশা করি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নতুন ইতিহাস রচিত হবে। আমর এটাও আশা করি, এ রায়ের মধ্য দিয়ে বিচারবিভাগীয় কলঙ্ক কিছুটা হলেও দূর হবে। আমরা এটাও আশা করি, যে জুলুমতন্ত্র তৈরি হয়েছিল তা কিছুটা হলেও অবসান হবে। আর যারা সিন্ডিকেটেড বিচারের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, সময়ের ব্যবধানে তারাও একদিন বিচারের সম্মুখীন হবেন।

আপিল শুনানীতে শিশির মনির বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ছিল সাজানো ও পূর্ব পরিকল্পিত। বিচারের নামে অবিচার করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার লেখা ব্রোকেন ড্রিম বইয়ে এই সত্যটা উঠেছে।

এটিএম আজহার প্রসঙ্গে শিশির মনির শুনানিতে বলেন, আরো সময় সময় পেলে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের ফাঁসি কার্যকর করতেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সময় তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অন্যায়ভাবে এটিএম আজহারে ফাঁসি কার্যকর করলে আমরা আদালতের সামনে আসতে পারতাম না। আপনাদের সামনে সুবিচার করার সুযোগ এসেছে।

জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারকে ঘিরে কীভাবে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমান আযমী, ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশেম, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে কীভাবে গুম করে আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল তা তুলে ধরেন।

আইনজীবী শিশির মনিরের আবেগঘন শুনানি চলাকালীন এজলাস কক্ষে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল।

মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিল শুনানিতে সাক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. শিশির মনির। তিনি বলেছেন, মামলার দুটি সাক্ষ্যেই ঘটনার বর্ণনায় ভিন্নতা রয়েছে, যা এই মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, প্রসিকিউশনের ১১ ও ১২ নম্বর সাক্ষী সাখাওয়াত হোসেন রাঙ্গা ও তার ভাই সাজ্জাদ হোসেন আজহারের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। রাঙ্গা বলেন, আজহার ডান হাত দিয়ে তার ডান গালে থাপ্পড় দেন। অথচ স্বাভাবিকভাবে ডান হাতের থাপ্পড় সাধারণত বাম গালে লাগে। এ নিয়ে তিনি প্রশ্ন রাখেনÑ ‘ডান হাতের থাপ্পড় কীভাবে ডান গালে লাগল?’

শুধু তাই নয়, রাঙ্গা বলেন, তিনি থাপ্পড়ে ছিটকে পড়ে যান ও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অথচ পরে দাবি করেন, অজ্ঞান অবস্থায় আজহার তাকে নির্যাতন করেন। আইনজীবীর প্রশ্ন, অজ্ঞান থাকা অবস্থায় কীভাবে নির্যাতনের বিষয়টি রাঙ্গা জানলেন?

অন্যদিকে, রাঙ্গার ভাই সাজ্জাদ আদালতে বলেন, আজহার রাঙ্গাকে ডান হাতে বাম গালে থাপ্পড় দেন। একই ঘটনায় এমন দুই রকম বর্ণনা সাক্ষ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে আদালতকে জানান শিশির মনির।

তিনি আরও বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফৌজদারি মামলায় যদি যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ থাকে, তাহলে কাউকে সাজা দেওয়া যায় না। তিনি বিভিন্ন মামলার নজির আদালতে উপস্থাপন করেন এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বই ‘ব্রোকেন ড্রিম’-এর একটি অংশও তুলে ধরেন।

শিশির মনির বলেন, ‘আমরা সময়ের প্রেক্ষাপটে আজ আপনার কাছে এসেছি। এটা সম্ভব হয়েছে ৫ আগস্টের পর দেশের পরিস্থিতির বদলের কারণে।” তিনি আদালতে এটিএম আজহারের বার্তা তুলে ধরে বলেন, “তিনি বলেছেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করো, কারো কাছে বলার দরকার নেই।’

এই শুনানিতে আজহারের বিরুদ্ধে ষষ্ঠ নম্বর অভিযোগ নিয়ে কথা হয়, যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। এর আগে ২০১৪ সালে ট্রাইব্যুনাল আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০১৯ সালে আপিল বিভাগ এই রায় বহাল রাখে। পরে তিনি ২০২০ সালে রিভিউ আবেদন করেন এবং চলতি বছর তার পূর্ণাঙ্গ আপিলের শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়।

গত ২২ এপ্রিল আপিল শুনানির জন্য ৬ মে দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। ২৬ ফেব্রুয়ারি আপিলের অনুমতি দেন সর্বোচ্চ আদালত। একইসঙ্গে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আসামিপক্ষকে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে বলা হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা এটাই প্রথম কোনো মামলা যে মামলায় রিভিউ থেকে মূল আপিল শুনানির অনুমতি দিলেন আদালত।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদনের প্রথম দিনের শুনানি শেষ হয়। তার আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য্য মঙ্গলবার ধার্য করেন আপিল বিভাগ।

২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। তখনকার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ রায় দেন। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলাম।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ১১৩ যুক্তিতে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপিল করেন তার আইনজীবীরা। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০ পৃষ্ঠার মূল আপিলসহ ২৩৪০ পৃষ্ঠার আপিল দাখিল করা হয়।