আওয়ামী আমলের অর্থ পাচারের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও পরিবারের সদস্যসহ ১১ শিল্পগোষ্ঠীর রাঘব বোয়ালের বিরুদ্ধে গত ১৪ মাসে ৭৯ টি মামলা করেছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র সংস্থা-দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। যৌথভাবে তদন্তের পর এই দুই সংস্থার দায়ের করা মামলার মধ্যে একমাত্র দুদকই চাজর্শিট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে ৬ টি মামলায়। এ যাবত হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে বাকী ৭৩ টি মামলা এখনও তদন্তানাধীন। শিগগিরই আরও কয়েকটি মামলায় চার্জশিট দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি। সূত্র মতে, তদন্ত শেষে মামলার সংখ্যা দাঁড়াবে শতাধিক।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার এবং ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থপাচার, কর ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। বিদেশে টাকা পাচার করে সেই অর্থে ব্যবসার মালিকানা এবং ফ্ল্যাট ও বাড়ি কেনায় বিনিয়োগ করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছে দুদক। তাদের সঙ্গে রয়েছে সিআইডি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই তিন সংস্থার কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে অর্থপাচার প্রতিরোধে কাজ করা আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে গত ডিসেম্বরে দাখিল করা শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে গড়ে প্রতি বছর ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কাজ শুরু হওয়ার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ইউরোপী ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাদের কাছ থেকে আশ্বাস মিলেছে। কূটনৈতিক পর্যায়েও আলোচনা হচ্ছে। তবে, এখনও সফলতার মুখ দেখেনি বর্তমান সরকার।
এদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি যে ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে রাষ্ট্রের তিন সংস্থার যৌথ তদন্ত দল (জেআইটি) গঠন করা হয়েছিল, সেই শিল্পগোষ্ঠীর তালিকায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তালিকা থেকে যশোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) কাজী নাবিল আহমেদের জেমকন গ্রুপকে বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এইচ বি এম ইকবালের প্রিমিয়ার গ্রুপকে। নতুন তালিকায় তদন্তের আওতায় থাকা শিল্পগোষ্ঠীগুলো হল, বসুন্ধরা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, আরামিট গ্রুপ, সামিট গ্রুপ এবং প্রিমিয়ার গ্রুপ। এসব গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তদন্তের তালিকায়।
দুদকের মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. মোকাম্মেল হক বলেন, প্রিমিয়ার গ্রুপের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থপাচার এবং কর ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ তদন্তে একটি চার সদস্যের দল গঠন করা হয়েছে। দলের নেতৃত্বে রয়েছেন উপপরিচালক মো. হোসাইন শরীফ। এই দলে সিআইডি ও এনবিআর কর্মকর্তারাও যুক্ত হবেন বলে জানান মোকাম্মেল।
জেমকন তদন্ত থেকে রেহাই পাচ্ছে কি না জানতে চাইলে বিএফআইইউ-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জেমকন গ্রুপকে তদন্তের বাইরে রাখা হয়নি বা ছাড় দেওয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের মানি লন্ডারিং বা আর্থিক অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই তাদের বিষয়টি এখন যৌথ তদন্তের বদলে দুদকের সাধারণ অনুসন্ধান পর্যায়ে দেখা হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, যৌথ তদন্তের মূল লক্ষ্য হল বিদেশে পাচার করা বড় অঙ্কের অর্থের সুনির্দিষ্ট উৎস ও প্রবাহ শনাক্ত করা এবং তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, দুদকের ১১টি অনুসন্ধান দল অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো তদন্ত করছেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে যে দল, তার নেতৃত্বে আছেন দুদকের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম। দলে রয়েছেন সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর, এস এম রাশেদুল হাসান, আতিয়া মোবাশ্বেরা তমা। যৌথ তদন্ত কাঠামোর আওতায় শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুদক মোট ১৮টি মামলা করেছে, যার তদন্ত চলছে। এর মধ্যে ছয়টি মামলায় ইতোমধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, যিনি বদলি হওয়া উপপরিচালক শেখ গোলাম মাওলার স্থলাভিষিক্ত। দলের সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক মো. সাজিদ-উর-রোমান ও মো. মাহমুদুল হাসান ভূঁইয়া। এখনও কোনো মামলা দায়ের করেনি এই গ্রুপ।
বেক্সিমকো গ্রুপের অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্বে আছেন উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন। দলে রয়েছেন উপপরিচালক সাজ্জাদ হোসেন ও মিনহাজ বিন ইসলাম। এখন পর্যন্ত বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে দুদক তিনটি এবং সিআইডি ১৭টি মামলা করেছে।
এইচবিএম ইকবালের প্রিমিয়ার গ্রুপের অভিযোগ অনুসন্ধান দলের নেতৃত্বে আছেন উপপরিচালক হোসাইন শরীফ। তার সঙ্গে রয়েছেন উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, সহকারী পরিচালক আজগর হোসেন ও উপসহকারী পরিচালক সাবরিনা জামান।
নাবিল গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে উপপরিচালক মো. মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত দল। সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান ও হাবিবুর রহমান। তারা এখন পর্যন্ত দুটি মামলা করেছেন।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান দলের নেতৃত্বে আছেন উপপরিচালক মো. রাউফুল ইসলাম। দলের অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক সোহাকুল ইসলাম ও মো. আব্দুল মালেক। তারা এখন পর্যন্ত চারটি মামলা করেছেন।
ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করছেন উপপরিচালক মো. রাশেদুর রহমান। তার দলে রয়েছেন মো. মেহেদী মুসা জেবিন ও খোরশেদ আলম। এখনো কোনো মামলা হয়নি।
এস আলম গ্রুপের বিষয়ে তদন্তের দায়িত্বে আছেন উপপরিচালক তাহসিন মুনাবীল হক। সহকারী পরিচালক মো. ইসমাঈল ও মাহমুদুল হাসান এই দলের সদস্য। তারা এখন পর্যন্ত ১৬টি মামলা করেছেন।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের দায়িত্ব প্রথমে ছিল উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানের হাতে। তার বদলির পর দায়িত্ব পান উপপরিচালক মশিউর রহমান। দলের অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক মো. মাইনউদ্দীন ও মুহা. শোয়াইব ইবনে আলম। এই দলটি এখন পর্যন্ত ১১টি মামলা করেছে।
সিকদার গ্রুপের বিষয়ে অনুসন্ধানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পরিচালক মো. মঞ্জুর মোর্শেদ। তার সঙ্গে আছেন সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান ও মো. কামিয়াব আফতাহি উন নবী। তারা এখন পর্যন্ত সাতটি মামলা করেছেন।
সামিট গ্রুপের অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্বে আছেন উপপরিচালক আলমগীর হোসেন। তার সঙ্গে রয়েছেন সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম ও মো. নাসরুল্লাহ হোসাইন। তদন্ত শেষে তারা একটি মামলা দায়ের করেছেন, যা বর্তমানে তদন্তাধীন।
যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক মাঠে নেমেছে, তাদের সবাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বলে অভিযোগ আছে। কেউ কেউ আবার সরকারের মন্ত্রী ও মন্ত্রী পদমর্যাদায় দায়িত্বে ছিলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে দিন দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও দেশ ছাড়েন। শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার সাবেক উপদেষ্টা জয় আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র্র প্রবাসী। আর রেহানার মেয়ে টিউলিপ যুক্তরাজ্য সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। যুক্তরাজ্যে থাকা তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান সম্প্রতি আলোচনা আসেন সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের বিষয়ে তোলপাড় শুরু হলে। টিউলিপকে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়। সামিট গ্রুপের কর্ণধার আজিজ খান কয়েক দশক ধরে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। আরামিট গ্রুপের কর্ণধার সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে অবস্থানের খবর এসেছে। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম (এস আলম) দেশের বাইরে থাকার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তবে ক্ষমতার পালাবদলের তার পরিবারের অন্যদের প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। বসুন্ধরা, নাবিল, ওরিয়ন, জেমকন ও সিকদার গ্রুপের মালিকদের কাউকেও প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, সামিট, ওরিয়ন ও নাসার মালিকদের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল-সিআইসির অনুসন্ধান শুরুর খবর আসে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এসব শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ বা অবরুদ্ধ করার খবরও আসে।