গণহত্যায় জড়িতদের বিচার না হলে শহীদ ও আহতদের ওপর অবিচার হবে --অ্যাটর্নি জেনারেল

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামীর বিরুদ্ধে করা মামলার রায় কবে হবে, তা জানা যাবে আগামী ১৩ নবেম্বর। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় কবে হবে, তা জানানোর তারিখ নির্ধারণ করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। রায়ের তারিখ নির্ধারণের আগে এই মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।

এ মামলার অপর দুই আসামী হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন। গতকাল এ মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সমাপনী বক্তব্য দেন। তিনি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেন।

পরে আসামীপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্যের জবাব দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনিও শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ শাস্তি চান।

এরপর মামলার পলাতক আসামী শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি চান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ পর্যায়ে তার (আসামীপক্ষের আইনজীবী) বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও তাকে কথা বলার সুযোগ দেন ট্রাইব্যুনাল।

অ্যাটর্নি জেনারেল ও চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের জবাব দেন আসামীপক্ষের আইনজীবী। পাশাপাশি তিনি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের খালাস প্রার্থনা করেন। পরে ট্রাইব্যুনাল এই মামলার রায় কবে দেওয়া হবে, তা আগামী ১৩ নবেম্বর জানানো হবে বলে জানান। আসামীপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বুধবার তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছিলেন।

শেখ হাসিনাসহ তিন আসামীর বিরুদ্ধে মামলায় গতকাল যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। এ সময় চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গন্ডগোল লাগানোর চেষ্টা করেছেন। শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রের মধ্যে শেখ হাসিনা একটা সিভিল ওয়ার (গৃহযুদ্ধ) লাগানোর চেষ্টা করেছেন। সেনাবাহিনীকে বলার চেষ্টা করেছেন, তোমাদের অফিসারদের বিচার হয়, তোমরা কেন রুখে দাঁড়াচ্ছ না?

ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আরো বলেন, যারা এখানে আসামী হয়েছেন, তাদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান) মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। এত বড় অপরাধ করেছেন, দুনিয়ার সবাই জানে এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তিনিও জানেন কিন্তু কখনোই তার মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনা পরিলক্ষিত হয়নি। উল্টো তিনি যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তাদের হত্যা করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলছেন। তাদের লাশগুলো বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার কথা বলছেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষে তিনি (শেখ হাসিনা) রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গন্ডগোল লাগানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি সেনাবাহিনীকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেনাবাহিনীকে বলার চেষ্টা করেছেন, তোমাদের অফিসারদের বিচার হয়, তোমরা কেন রুখে দাঁড়াচ্ছ না? রাষ্ট্রের মধ্যে একটা সিভিল ওয়ার (গৃহযুদ্ধ) লাগানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সেই পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। বাংলাদেশের জনগণ সেই পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। যারা পারপিট্রেটর (অপরাধী) ছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তাদের অঙ্গীকারের প্রতি দৃঢ় আছেন। আদালতে তাদের নিয়ে এসেছেন। বিচারের প্রক্রিয়া স্মুথলি সামনে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো উসকানিতে কেউ পা দেয়নি।

চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, এ রকম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, পুরো প্রজন্মকে হত্যা করে ফেলার চেষ্টা, ৩৫ হাজার মানুষকে আহত করা, অঙ্গহানি করা, এরপরও সামান্যতম রিমোর্স (অনুশোচনা) না থাকা। এখানে শিশু ছিল, নারী ছিল, মজুর ছিল, ছাত্ররা ছিল, তাদের হত্যা করতে তার বুক কাঁপেনি। এখন পর্যন্ত তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। সুতরাং সর্বোচ্চ শাস্তিটা তার অবশ্যই প্রাপ্য।

তাজুল ইসলাম আরো বলেন, যারা অপরাধী ছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তাদের অঙ্গীকারের প্রতি দৃঢ় আছেন। আদালতে তাদের নিয়ে এসেছেন। বিচারের প্রক্রিয়া স্মুথলি সামনে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকাল সোয়া ৩টা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার যুক্তিতর্ক চলে। সাক্ষীদের জবানবন্দি নিয়ে বুধবার যুক্তি খ-ন করেন আমির হোসেন। বিশেষত রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সাক্ষ্য সামনে আনেন। একইসঙ্গে তাদের দেওয়া সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এ মামলার রাজসাক্ষী মামুন বাঁচতে চাইছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া মাহমুদুর রহমান ভিন্ন মতাদর্শী হওয়ায় শেখ হাসিনাকে দেখতে পারেন না বলেই জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে তার সাক্ষ্য এ মামলায় প্রভাব পড়বে না বলেও যুক্তি দেখিয়েছেন এই আইনজীবী। পরে যুক্তি উপস্থাপন করেন রাজসাক্ষী মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। তিনিও মামুনের খালাস চেয়েছেন। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, সুলতান মাহমুদসহ অন্যরা।

গত ২১ অক্টোবর দুপুরের পর দ্বিতীয় দিনের মতো যুক্তি উপস্থাপন করেন আমির হোসেন। ওই দিন সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি নিয়ে বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি। ২০ অক্টোবর পলাতক আসামীদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত এই আইনজীবী। তিনি নিজের যুক্তিতর্কে শেখ হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষে আনা অভিযোগসহ বিভিন্ন বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামল, একাত্তরের পটভূমি, শাপলা চত্বরে হত্যাযজ্ঞ ও ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের কথা তুলে ধরেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, গণহত্যায় জড়িত শেখ হাসিনাসহ আসামীদের বিচার না হলে জুলাই শহীদ-আহতদের ওপর অবিচার করা হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার সর্বশেষ দিনের যুক্তিতর্ক তুলে ধরার সময়ে তিনি এ কথা বলেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি বিশ্বাস করেছিলাম, শেখ হাসিনা ন্যায়বিচারের মুখোমুখি হবেন। কারণ তিনি অন্যের উদ্দেশে বলেছিলেন, সাহস থাকলে বিচারের মুখোমুখি হন। কিন্তু তিনি এই কথা মন থেকে বলেননি। বললে আজ দেশের মাটিতে এসে বিচারের মুখোমুখি হতেন।

মো. আসাদুজ্জামান আরও বলেন, এই আসামীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের আরও অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ভীরু-কাপুরুষ হয়ে রয়ে যাবে। আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি। তার বক্তব্যের পর ট্রাইব্যুনাল বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। দুই পক্ষই যেকোনো মূল্যে ন্যায়বিচার পাবে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবার, আহত, চিকিৎসকসহ ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যে উঠে আসে জুলাই গণহত্যা, নৃশংসতা, আওয়ামী লীগের আমলে গুম-খুনসহ নির্যাতনের নানা বিষয়। এই মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন জুলাই আগস্টের গণহত্যাকালীন পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি তুলে ধরেন গণহত্যার পেছনের ঘটনাও। উঠে আসে নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকাদের নাম। প্রসিকিউশন বলছে, এখন পর্যন্ত যেসব সাক্ষ্য, প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে, তা দ্বারা পৃথিবীর যেকোনো আদালতে আসামীদের অপরাধ প্রমাণে যথেষ্ট।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ (প্রসিকিউসন) এই মামলা প্রমাণের জন্য দালিলিক, মৌখিক, সারকামস্টেনশিয়াল সাক্ষী উপস্থাপন করেছে। কিন্তু আসামীপক্ষ বলেছেন, আসামীরা গুলি চালানোর কোনো নির্দেশ দেননি, তারা নির্দোষ। ভাগ্যিস উনি (আসামীপক্ষের আইনজীবী) বলেননি বাংলাদেশে কোনো জুলাই বিপ্লব হয়নি। ভাগ্যিস উনি বলেননি বাংলাদেশে ১৪শ মানুষ মারা যাননি, ৩০ হাজারের উপরে আহত মানুষ হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের ১৪শ মানুষ মারা গেলেন। এই ফ্যাক্টটাকে যদি আমরা সামনে রাখি, সারা দেশে এতবড় একটা জুলাই বিপ্লব হলো, সারা দেশে হত্যাকা- হলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায়, সরকারের পৃষ্টপোষকতায় স্টেট অ্যাপারেটাস (রাষ্ট্রযন্ত্র) ব্যবহার করে তাহলে কে করলেন?

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আদালতের কাছে আমাদের নিবেদন হচ্ছে- অপরাধ কে বা কারা করেছে, কিভাবে করেছে প্রসিকিউশনের উপস্থাপন করা সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সেটি তুলে ধরা হয়েছে। আসামীরা যে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্বিচার হত্যাকা- চালিয়েছে, পদ্ধতিগতভাবে ব্যাপক মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এই বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ সন্দোহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ দেখিয়েছে, কার নির্দেশনা ছিল, কিভাবে নির্দেশনা ছিল, কার কাছে নির্দেশনা ছিল, নির্দেশনা কিভাবে অপারেট (পরিচালনা) করা হয়েছে, কে অপারেট করেছেন, কে এক্সিকিউট (বাস্তবায়ন) করেছেন নির্দেশনা। অভিযুক্তরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন এবং তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। উনারা এই বিচার সম্পর্কে জানেন, বিচার পর্যবেক্ষণ করছেন। এই বিচারের বিষয়ে কথা বলেছেন। এই বিচারকে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন রকম ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছেন। ফলে এটা বলার সুযোগ নেই অভিযুক্তরা নিরাপরাধ। পালিয়ে গিয়েও তারা ক্ষান্ত হননি। বিচারকে ব্যাহত করার জন্য তার সর্বোচ্চ অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল ট্রাইব্যুনালকে বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে সাক্ষ্য-প্রমাণ আপনাদের সামনে এসেছে, সেই সাক্ষ্য বিশ্বের যেকোনো দেশের যেকোনো আদালতের সামনে উপস্থাপন করলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে এই আসামীদের সাজা প্রদান ছাড়া বিকল্প কোনো পথ থাকবে না আদালতের সামনে। আজকে আমরা দাঁড়িয়েছি এই বাংলাদেশেকে সভ্যতার সোপানে, একটি সামনের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই ন্যায়বিচার যদি আমরা না করতে পারি, তাহলে আমরা বাংলাদেশে মানুষ হিসেবে কবি হেলাল হাফিজের ভাষায় উত্তর পুরুষের ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাব।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অনেকে বলছেন- খুনিরা ন্যায়বিচার পাবে কিনা? বাইরে অনেক রকম কথা আছে। খুনিদের ন্যায়বিচারের মানদ-ে ন্যায়বিচার করা হচ্ছে কিনা? আমার নিবেদন হলো- আপনারা কেবল খুনির ন্যায়বিচার দেখবেন? ৩৬ দিনে যে ১৪শ মানুষ নিহত হলো, তারা কি ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন না? যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তারা কি ন্যায়বিচার পাবেন না? রাষ্ট্র কি ন্যায়বিচার পাবে না? যারা পালিয়ে গেছে, পালিয়ে গিয়ে ন্যায়বিচারকে পরাভূত করার চেষ্টা করছে, তার পরেও তাদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স দিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়াটা কি ন্যায়বিচার না? সেখানে দিবালোকের মতো সত্য এখানে মানুষ মারা গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কারা ঘটিয়েছে, কিভাবে ঘটিয়েছে, আমরা সেটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করি, যদি এই আদালতে এই আসামীদের শাস্তি না হয়, তাহলে মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষায় বলবো, এদেশের খুন হওয়া মানুষ, পঙ্গুত্ববরণকারী মানুষ, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা অবিচারের শিকার হবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি প্রত্যাশা করেছিলাম উনি (শেখ হাসিনা) ন্যায়বিচারের সামনে আসবেন। উনি এক রাজনৈতিক বক্তৃতায় আরেকজন রাজনৈতিক নেতার রেফারেন্স টেনে বলেছিলেন, সাহস থাকলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে বিচারের মুখোমুখি হোক। আমার বিশ্বাস ছিল, উনি এই কথাটা মন থেকে বলেছিলেন। আমার বিশ্বাস ছিল, উনি এটা বিশ্বাস করে বলেছিলেন। আজকে আমি দেখলাম, উনি মন থেকে বলেননি, বিশ্বাস থেকে বলেননি। উনার যদি সাহস থাকতো তাহলে উনি বাংলাদেরে মাটিতে এসে এই বিচারের মুখোমুখি হতেন।

একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই বিচার যত কঠিনই হোক, যত বাধা আসুক, সমস্ত বাধার প্রাচীর ভেঙে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা জতি হিসেবে আগামী দিনে এগোতে পারব না। যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে এই আসামীদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। এই আসামীদের হাতে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। পাঁচ বছরের শিশু মারা গেছে। ১০ বছরের আনাস মারা গেছে। পানি বিতরণ করা অবস্থায় মুগ্ধ মারা গেছে। বুক চিতিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদ মারা গেছে। আমরা যদি ন্যায়বিচার শেষ করতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবে। সেই কারণেই আমরা মনে করি, এই বিচারে আমরা যা প্রমাণ করেছি, সেটা সন্দেহাতীত।

এই মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করেন। এছাড়া শুনানিতে প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ, শাইখ মাহদি, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আর রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ-আল মামুনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ-আল মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেন সাবেক আইজিপি মামুন। ঐতিহাসিক এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক শহীদ আবু সাঈদের বাবাসহ স্বজনহারা পরিবারের অনেকে। এছাড়া স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। সর্বমোট এই মামলায় ৫৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।

এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায়। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকা-ের ঘটনায়। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার চলছে।