চব্বিশের পাঁচ আগস্ট। দিনটিতে সাভারের আশুলিয়া থানার সামনে ঘটেছিল এক বীভৎস ঘটনা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ছয় তরুণের লাশ। পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেন খোদ থানার ওসি-এএসআই। সেই ভীবৎস্য ঘটনার সত্য ফাঁস করলেন এএসআই শেখ আবজালুল হক।

আসামী থেকে রাজসাক্ষী হওয়া ৩৪ বছর বয়সী এই এসআই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দীতে নিজের জানা সব কথা তুলে ধরেন। ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে কীভাবে গুলী চালানো হয়েছিল নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর, কীভাবে লাশে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়; সবকিছুর বিবরণই দেন আবজালুল। এমনকি সিভিল পোশাকে থানার পেছন দিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার কথাও জানান।

আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল গতকাল বুধবার। বেলা ১১টার পর ২৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনাল-২ এর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেলে আবজালুলের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়।

সাক্ষীর ডায়াসে উঠে প্রথমেই নিজের পরিচয় দেন শেখ আবজালুল। বর্তমানে এ মামলায় আসামী হিসেবে কারাগারে রয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি পুলিশে এসআই হিসেবে যোগদান করেন। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা রেঞ্জের আওতাধীন ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানায় যোগদান করেন আবজালুল। সাভার ও আশুলিয়া থানা নিয়ে একটি সংসদীয় আসন। ওই আসনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এমপি ছিলেন মো. সাইফুল ইসলাম।

জবানবন্দীতে আবজালুল বলেন, ২০২৪ সালে জুলাইয়ে আন্দোলন চলাকালীন আশুলিয়া থানার ওসি এএফএম সায়েদ স্যারকে মোবাইলে আন্দোলন দমনসহ বিরোধীদের গ্রেপ্তার করতে মাঝেমধ্যে নির্দেশনা দিতেন এমপি সাইফুল। এসব নির্দেশনা অধস্তন কর্মকর্তাদের দিয়ে বাস্তবায়ন করতেন ওসি স্যার। ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানাধীন পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে আমি সকালে থানায় পৌঁছাই। এরপর অস্ত্রাগার থেকে আমার নামে ইস্যু করা পিস্তল ও গুলী নিয়ে থানার পশ্চিম পাশে দায়িত্বে নিয়োজিত হই।

তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হেলার (হ্যান্ড মাইক) দিয়ে থানার সব কর্মকর্তা ও অধস্তনদের নিচে ডাকেন ওসি স্যার। সবার উদ্দেশে জুলাই আন্দোলনে শক্তভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেন। এরপর অন্য ইউনিট থেকে আসা বেশিরভাগ কর্মকর্তা ও ফোর্সদের নিয়ে বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে যান তিনি। আমাদের দায়িত্ব ছিল থানার গেটে ও ভেতরে। দুপুর আড়াইটায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে ফোর্স নিয়ে থানায় চলে আসেন সায়েদ স্যার।

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, থানায় আসার পর কিছু লোককে থানার পূর্ব ও পশ্চিম পাশে মোতায়েন করেন। ওসি স্যারের সঙ্গে থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান স্যার, পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নির্মল কুমার স্যার, পুলিশ পরিদর্শক (ডিবি) আরাফাত হোসেন স্যার, এসআই আব্দুল মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই বিশ্বজিৎ, এএসআই কামরুল হাসান, কনস্টেবল মুকুল চোকদারসহ অন্য ইউনিট থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে থানার গেটে থাকেন। বিকেল ৪টায় ছাত্র-জনতার একটি অংশ থানার দিকে বিজয় মিছিল নিয়ে আসে। ওই সময় ওসি স্যারের সরাসরি নির্দেশে এএসআই বিশ্বজিৎ ও অন্য ইউনিট থেকে আসা কয়েকজন পুলিশ সদস্য মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলী ছোড়েন। তাৎক্ষণিক কয়েকজন গুলীবিদ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যান।

আবজালুল বলেন, ঠিক তখনই ওসি স্যার ফোনে ‘স্যার স্যার’ বলে পায়চারি করছিলেন। পরে ওসি স্যারের নির্দেশে কয়েকজন পুলিশ সদস্য পড়ে থাকা লাশগুলোকে তিন চাকার ভ্যানে তুলে পুলিশের আরেকটি পিকআপভ্যানে ওঠান। ওই সময় সঙ্গে থাকা এসআই আব্দুল মালেক ও এএসআই বিশ্বজিৎকে নিয়ে পরামর্শ করছিলেন ওসি স্যার। আমি তাদের কাছাকাছি গেলে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তখন আমার মনে হলো তারা লাশগুলো নিয়ে অন্য পরিকল্পনা করছিলেন। আমি কিছুটা নার্ভাস অনুভব করি। সিদ্ধান্ত নিই এখানে থাকা আমার ঠিক হবে না। আমি থানায় ঢুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলে সিভিল পোশাকে পিস্তলটি প্যান্টের সামনের দিক দিয়ে গুঁজে সাধারণ মানুষের মতো থানা থেকে বের হয়ে যাই। পরে ফল বিক্রেতা কামালের সঙ্গে ভাড়া বাসায় উঠি।

তিনি বলেন, এরপর ফজরের আজান পর্যন্ত থেকে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে থানার পশ্চিম পাশে এসএ পরিবহনের গলি দিয়ে বাইপাইল হয়ে ভাড়া বাসায় যাই। ১৫ আগস্ট থানায় গিয়ে আমার নামে ইস্যু করা পিস্তল ও গুলি জমা দিই। তখন জানতে পারি, পুলিশ যাদের হত্যা করে পিকআপে রেখেছিল, সেসব লাশ ওইদিনই ওসি সায়েদ স্যার ও বিশ্বজিৎ মিলে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেন। পরে তারা বিকেল সাড়ে ৫টায় থানা ছেড়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে চলে যান।

এই রাজসাক্ষী আরও বলেন, তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম স্যার, তৎকালীন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান রিপন স্যার, সাভার (ক্রাইমস অ্যান্ড অপস) এডিশনাল এসপি (এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহিল কাফি স্যার, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল স্যারদের এ ঘটনা নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। পরে আমি চলতি বছরের মে মাসে গ্রেপ্তার হই। তবে আমি শহীদ ভাইদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে কোনো ধরনের প্ররোচনা ও প্রলোভন ছাড়া এই মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য আবেদন করি। যেন ট্রাইব্যুনালকে এ মামলার বিষয়ে সত্য তথ্য দিয়ে বিচারকাজে সহায়তা করে শহীদ ভাইদের ঋণ কিছুটা পরিশোধ করতে পারি। আমি শহীদ ভাইদের জন্য কিছু করতে না পারায় তাদের পরিবার ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আবজালুলকে আংশিক জেরা করেন আসামীপক্ষের আইনজীবী। পরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, সহিদুল ইসলাম, মঈনুল করিম ও সাইমুম রেজা তালুকদার।