একমাত্র ছেলে মুসার আইসক্রিম খাওয়ার ছোট্ট আবদার মেটাতে ছয়তলা বাসার নিচে নেমেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। নাতির সাথে দাদি মায়া ইসলামও তাদের সঙ্গে আসেন। কিন্তু নিচে নামতেই পরিস্থিতি রূপ নেয় এক বিভীষিকায়। পুলিশের ছোড়া গুলী এসে লাগে মুসার মাথায়। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই গুলীটি বেরিয়ে দাদি মায়া ইসলামের পেটে লাগে। সেই বুলেটে মুহূর্তেই ছটফট করতে করতে প্রাণ হারান মায়া। অন্যদিকে, আদরের মুসা বেঁচে গেলেও সেই ঘটনার পর থেকে সে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে।

হৃদয়স্পর্শী এমনই বর্ণনা উঠে এসেছে ছয় বছর বয়সী বাসিত খান মুসার বাবা মোস্তাফিজের মুখে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলী করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল গতকাল (সোমবার)। দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে মোস্তাফিজের জবানবন্দি রেকর্ড করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

এদিন সোয়া ১১টার দিকে সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন মোস্তাফিজ। শুরুতেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি রাজধানীর মালিবাগে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির ব্যবসা করেন। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকেল ৩টা-সাড়ে ৩টার দিকে বাবাকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন এই ব্যবসায়ী। এরপর তাদের পরিবারে নেমে আসে নির্মমতা। জবানবন্দিতে মোস্তাফিজ বলেন, ওই দিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আইসক্রিম খেতে চায় মুসা। তখন আমি মা ও ছেলেকে নিয়ে নিচে নামি। মাকে বলি আইসক্রিম কিনে দেওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে বাসায় যেতে। কিন্তু নিচে নামার পর গেটের বাইর থেকে পুলিশের ছোড়া একটি গুলী আমার ছেলের মাথায় লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক আমি ছেলেকে কোলে করে পার্শ্ববর্তী ফেমাস হাসপাতালে নিয়ে যাই।

তিনি বলেন, প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন চিকিৎসকরা। আমি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা হাসপাতালে পৌঁছাই। ফোন করলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন আমার বাবা ও স্ত্রী। চিকিৎসকরা আমার ছেলের মাথায় অপারেশন করেন। তখন আমি মাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাকে বার বার ফোন করেও পাইনি। পরবর্তী সময়ে আমার এক প্রতিবেশীকে ফোন করে ফ্ল্যাটে গিয়ে মায়ের খোঁজ করতে বলি। আমার ছেলের মাথায় লাগা গুলীটি মাথা ভেদ করে মায়ের পেটে লেগেছে বলে জানান তিনি। তবে, আমি তাৎক্ষণিক ছেলেকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসায় বিষয়টি জানতে পারিনি। প্রতিবেশী আরও জানান, তারা আমার মাকে তাৎক্ষণিকভাবে ফরাজি হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। তিনি এখন সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন। আমি যেন আমার কোনো আত্মীয়কে মায়ের কাছে ফরাজী হাসপাতালে পাঠাই। বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই মাকে প্রতিবেশীরা হাসপাতালে নেওয়ার কারণে আমার স্ত্রীও গুলী লাগার সংবাদ জানতে পারেননি।

এই সাক্ষী বলেন, বাইরে অনেক গোলাগুলী হওয়ার কারণে আমরা কেউ ঢাকা মেডিকেল থেকে বের হয়ে ফরাজী হাসপাতালে যেতে পারছিলাম না। পরে সারোয়ার হোসেন নামে এক আত্মীয়কে ফোন করে দ্রুত সেখানে যেতে বলি। তিনি গিয়ে মাকে ফরাজী হাসপাতালে শায়িত অবস্থায় দেখেন। চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। তবে, গাড়ি না পাওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে আনতে পারেননি। বাইরে তখন অনেক গোলাগুলী হচ্ছিল। ওই দিন রাত ১১টার দিকে বাবাকে ফরাজী হাসপাতালে পাঠাই আমি। রাতে অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বাবাও মাকে ঢাকা মেডিকেলে আনতে পারেননি। পরদিন ভোর ৫টার দিকে আমি ঢাকা মেডিকেল থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ফরাজী হাসপাতালে পাঠাই। এরপর মাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসেন বাবা। কিন্তু পথেই মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালে নামানোর পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাক্ষী।

মোস্তাফিজ আরও বলেন, আমার মায়ের লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমার ছেলে আইসিইউতে ছিল। মায়ের লাশ নিতে চাইলে রামপুরা থানা পুলিশের অনুমতি লাগবে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আমি রামপুরা থানার ওসির মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ফোনে অনুরোধ করি। যেন থানা থেকে একজন পুলিশ সদস্যকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। ২০ জুলাই দুপুরে মোটরসাইকেলে একজনকে আমি ঢাকা মেডিকেল থেকে রামপুরা থানায় পাঠাই। পরে সিভিল পোশাকে দুজন সাব-ইন্সপেক্টর আসেন। তবে, গুলীবিদ্ধ হওয়ায় লাশটি দেওয়া যাবে না বলে জানান তারা। অনেক অনুরোধের পরও তারা লাশ দিতে রাজি হননি। পরবর্তীতে তারা এই শর্তে রাজি হন যে, লাশ নিয়ে রামপুরায় যাওয়া যাবে না। তাদের কথামতো মায়ের লাশটি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করেন আমার বাবা। কিন্তু ছেলে আইসিউতে থাকায় আমি যেতে পারিনি।

ছেলের চিকিৎসা প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত আইসিইউতে ভর্তি ছিল আমার ছেলে। এরপর তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আইসিইউতে ভর্তি ছিল। অবস্থার অবনতি হতে থাকলে চিকিৎসকরা তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেয় চ্যানেল আই। ২৩ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত আমার ছেলেকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তার চিকিৎসার সব খরচ বহন করে সরকার। সিঙ্গাপুর থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ফের তাকে সিএমএইচে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ৯ জুলাই পুনরায় সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। এবার ২৬ জুলাই পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসা নেয় ছেলেটি। সিঙ্গাপুর থেকে আনা খাবার এনজিটিউবের মাধ্যমে নাক দিয়ে গ্রহণ করে। বর্তমানে ছেলের ডানদিক প্যারালাইজড। কথাও বলতে পারে না। চলাফেরাও করতে পারে না।

জড়িতদের শাস্তি চেয়ে মোস্তাফিজ বলেন, আমার বাসা থেকে আনুমানিক ৭০ ফুট দূরে রামপুরা থানা ভবন অবস্থিত। আমি আমার বাসার গেট থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ওই থানার ওসি মশিউর রহমানসহ পুলিশ সদস্যরা সরাসরি গুলী করছিলেন। ওসিকে সরাসরি অস্ত্র হাতে গুলী করতে দেখেছি। সেখানে আরও অনেক পুলিশ ছিল। পরবর্তীতে জানতে পেরেছি সেখানে চঞ্চল নামে একজন পুলিশ ছিলেন। আমার মায়ের হত্যা ও সন্তানের এই অবস্থা করার জন্য দায়ীদের বিচার চাই। একপর্যায়েও ফের কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন পলাতক তিন আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেপ্তার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর আবদুস সোবহান তরফদার, সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা। এখন পর্যন্ত এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন দুজন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী সোমবার (৩ নভেম্বর) দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।