বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর জানিয়েছেন, ওই সময় সারাদেশে তিন লাখ পাঁচ হাজার ১১ রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল পুলিশ। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা শহরে ব্যবহার করা হয়েছিল ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড।
গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ৫৪তম ও সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য জানান আলমগীর। তিনি ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ জবানবন্দি দেন। প্যানেলের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আলমগীর এর আগে রোববার প্রথম দিনের জবানবন্দি দেন। গতকাল সোমবার দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দি চলে এবং তা অসমাপ্ত রেখে শুনানি আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তার তদন্তকালে তিনি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জুলাই আন্দোলন দমনে ছাত্রজনতার ওপর ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি সংক্রান্ত ২২৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পান। এতে দেখা যায়, এলএনজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলবার, পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করে শুধু ঢাকা শহরে ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড ও সারাদেশে ৩ লাখ ৫ হাজার ১১ রাউন্ড গুলি ব্যবহার করা হয়।
আলমগীর জানান, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হত্যা ও নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও তিনি পেয়েছেন। এছাড়া র্যাব সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টার ব্যবহার সংক্রান্ত প্রতিবেদন পান গত ১৪ জানুয়ারি। ৮১টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নেন ৭ মে।
তদন্ত কর্মকর্তা জবানবন্দিতে বলেন, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে আন্দোলন দমনে শান্তিপূর্ণ ছাত্রজনতার ওপরে ব্যাপক মাত্রায় প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন।
জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, জুলাই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হত্যা, জখম, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সংগ্রহ করে জব্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে জখমী সাক্ষীদের চিকিৎসা সনদ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম থেকে ৮১ জন অজ্ঞাতনামা লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও সংগ্রহ করা হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা জবানন্দিতে আরও বলেন, তদন্তকালে সংগৃহীত, জব্দকৃত আলামত পত্রপত্রিকায় ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিক, বই পুস্তক, বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট, বিভিন্ন প্রতিবেদন, শহীদ পরিবারের সদস্য, জখমী, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানবন্দি, তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনা করি। পলাতক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজি মামুন গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ব্যাপক মাত্রায় আন্দোলন দমনে শান্তিপূর্ণ ছাত্রজনতার ওপরে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। প্ররোচনা, সম্পৃক্ততা, উসকানি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেড় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে জখম, অঙ্গহানি, বেআইনি আটক, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, অপহরণ, জীবিত ও মৃতকে একত্র করে পুড়িয়ে দেওয়া, চিকিৎসা, জানাজা, দাফন ও শেষকৃত্যে বাধা, মৃত্যুর কারণ পরিবর্তনে সংশ্লিষ্টদের বাধ্য করা হয়েছে।
মো. আলমগীর বলেন, আসামিরা নিহতদের মৃতদেহ পরিবার কর্তৃক শনাক্তের সুযোগ না দিয়ে বেওয়ারিশ আখ্যা দিয়ে তড়িঘড়ি করে লাশ দাফনে বাধ্য করা, আন্দোলনকারী ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করেছেন।
গত রোববার জবানবন্দীতে তদন্ত কর্মকর্তা আরও জানান, তদন্তকালে তিনি ১২-০২-২৫ সকাল ১১টায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিডফোর্ড হাসপাতাল থেকে জব্দ তালিকার মূলে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগ্রহীত ৩টি বুলেট জব্দ করেন। ১২-০২-২৫ সকাল ৫টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মিডফোর্ড হাসপাল থেকে জব্দ তালিকার মূলে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগ্রহীত ২০টি বুলেট ও ১৬টি পিলেট জব্দ করেন।
১৩-০২-২৫ সকাল ৮টায় জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পূর্নবাসন প্রতিষ্ঠান থেকে জব্দ তালিকার মূলে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগ্রহীত ১৯টি বুলেট জব্দ করেন।
১৩-০২-২৫ তারিখে ১টায় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরো সাইন্স থেকে জব্দ তালিকার মূলে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগ্রহীত ১টি বুলেট ও ৩টি পিলেট জব্দ করেন।
১৩-০২-২৫ তারিখে ২টায় সিএমএস থেকে জব্দ তালিকার মূলে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগ্রহীত ১৩টি বুলেট জব্দ করেন।
১৩-০২-২৫ তারিখে কর্মিটোলা জেনারেল হাসাপাতল থেকে জব্দ তালিকার মূলে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগ্রহীত ২টি বুলেট জব্দ করেন।১৬-০২-২৫ তারিখে সাড়ে ১১টায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউট থেকে জব্দ তালিকার মূলে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগ্রহীত ৬টি পিলেট জব্দ করেন।
১৩-০২-২৫ তারিখে ৩টায় জখমি সামাদ মিয়ার নিকট থেকে জব্দ তালিকার মূলে ১টি বুলেট জব্দ করেন।
২২-০২-২৫ তারিখে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের ফরেনসিক রিপোর্ট ও মনয়াতদন্তের রিপোর্ট ও অন্যান্য তথ্যাবলি জব্দ করেন।
০৮-০৩-২৫ সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরি থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে তামিম ভূঁইয়াকে গুলি করার ভিডিওসহ ১০টি আইটেমের ১২টি ভিডিও ফুটেজ হ্যাসট্যাগ ভ্যালুসহ জব্দ করেন এবং তা তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরিয়ানের জিম্মায় প্রদান করেন।
১৭-০৩-২৫ তারিখে ২টা ৩০ মিনিটে তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরি থেকে গঢ়৪ ভিডিও ফরমেটে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ছবি সংবলিত ২.৫০ সেকেন্ডের একটি ভয়েস বার্তা হ্যাসট্যাগ ভ্যালুসহ একটি অডিও ও ১টি ভিডিও ফুটেজ করেন এবং তা তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরিয়ানের জিম্মায় প্রদান করেন।