জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও সরাসরি নির্দেশসহ মানবতা বিরোধী পাঁচটি অভিযোগ এনেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এটাই প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামী করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। এরপর দুপুরে ট্রাইব্যুনালে সংবাদ সম্মেলন করে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।
দুপুর সাড়ে ১২টায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে আসামী করা হয়েছে। তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি বলেন, এ রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর সবকিছু দেখে বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ দাখিল করবেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগগুলোর মধ্যে দুটি অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছে। বাকিগুলো আপাতত সবার জন্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। সেগুলো পরে জানানো হবে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা প্রথম অভিযোগটি হচ্ছে, তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি ও প্ররোচনা দিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে রাজাকারের নাতিপুতি বলে উল্লেখ করেছিলেন। এটা বলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর তারা মানবতাবিরোধী এসব অপরাধ করে। এই উসকানির দায়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ উঠে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় যে অভিযোগের কথা বলা হয়েছে সেটা হচ্ছে সরাসরি নির্দেশের। তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনার অনেকগুলো টেলিফোন কনভারসেশন জব্দ করেছে। সেখানে তিনি বারবার সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় সব বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন, হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র-নিরীহ আন্দোলনকারীদের নির্মূল করতে। সরাসরি সেই নির্দেশের প্রমাণপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা হাতে পাওয়ার প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে এই দ্বিতীয় অভিযোগটি দাখিল করেছে।
এ ছাড়া বাকি ৩টি অভিযোগ সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে। যেখানে শেখ হাসিনার নির্দেশের প্রেক্ষিতে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে। কীভাবে মানুষকে মারা হয়েছে, নৃশংসতাগুলো করা হয়েছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঘটনাকেন্দ্রিক ওই ৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
চীফ প্রসিকিউটর বলেন, তদন্ত রিপোর্ট আমাদের আইন অনুযায়ী এটা সম্পূর্ণ ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট। এই তদন্ত রিপোর্টের কোন বিষয়বস্তু আমরা আসামী পক্ষে কেউ দিব না। আমরা কোথাও এটা দিতে বাধ্য নই এটা দিতে পারবো না। সুতরাং কার বিরুদ্ধে ইনভলভমেন্ট কিভাবে কতটুকু আছে সেই বিষয়টি এটা কেবলমাত্র ফরমাল চার্জের মাধ্যমে যখন আদালতে দাখিল করবো সেখানেই বলা হবে। এটা মিডিয়ার সামনে বলার বিষয় না বলা যাবে না। সাক্ষীর সংখ্যা সাক্ষীদের নাম পরিচয় এগুলো সম্পূর্ণ ক্লাসিফাইড বিষয়। তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটা প্রকাশযোগ্য নয়। সংখ্যাটাও প্রকাশযোগ্য নয়। না এই মামলাতে আমরা এটা করতে পারছি না। কারণ আমরা সাক্ষীদের সংখ্যা এবং সাক্ষীদের বিবরণ যদি প্রকাশ করি তাহলে মারাত্মকভাবে সাক্ষীর সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার প্রশ্নটি বিঘ্নিত হবে। সে কারণে আমরা এই বিষয়টি সাক্ষীদের ব্যাপারটি উন্মুক্ত করতে চাই না। হ্যাঁ বাকি দুজনকে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির পাশাপাশি তাদের সম্পৃক্ততা তাদের আরো অন্যান্য যে সমস্ত অভিযোগ আছে সেগুলো তাদের বিরুদ্ধে আসছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমি বলেছি যে, তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের পরের প্রক্রিয়াটা হচ্ছে চিফ প্রসিকিউটর এই তদন্ত রিপোর্ট এবং তদন্ত রিপোর্টের সাথে সম্পৃক্ত যে সমস্ত দাখিলকৃত দলিলাদি সাক্ষ্য প্রমাণাদি আছে এগুলো বিশ্লেষণ করে তিনি ফরমাল চার্জ তৈরি করবেন অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তৈরি করে সেটি আদালতের কাছে দাখিল করবেন আদালতে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হলে তখন থেকে আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রাটা শুরু হবে এবং এই যাত্রাটা ফরমাল চার্জ দাখিলের পরপরই শুরু হবে। রায় পেতে কতদিন সময় লাগবে এইটা বলার ক্ষমতা চীফ প্রসিকিউটরের নেই। কারোরই নেই। কারণ এটি নির্ধারণ করবেন আদালত। এটি নির্ধারণ করবে পরিস্থিতি কতজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষী দেবেন। কতটুকু সাক্ষী নেয়ার প্রয়োজন হবে। মামলা প্রমাণের জন্য যতদূর যেতে হবে ততদিন সময় প্রসিকিউশনকে দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে কখনোই বিচারকার্য পরিচালনা করা যায় না। এটা উচিত নয়। এটা বিতর্কের তৈরি করবে। এটা সমালোচনার বিষয় হবে। সুতরাং তদন্ত রিপোর্ট দাখিল হয়েছে। এখন আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফরমাল চার্জ দাখিল করব এবং ফরমাল চার্জ দাখিলের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রা শুরু হবে। সেটা সমাপ্তি কতদিনে হবে সেটা আদালত নির্ধারণ করবেন। এটা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে।
তাজুল ইসলাম বলেন, যে সংশোধনী গত রাত্রে আইনে এসেছে। এটা আমরা দেখেছি। সেখানে রাজনৈতিক দল অথবা সংগঠন হিসেবে তারা যদি অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয় তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা যাবে বলা হয়েছে এবং বিচারে তাদের বিরুদ্ধে কি কি শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে সে বিষয়টিও এখানে আনা হয়েছে। গত রাত্রে মাত্র এই আইনটা প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন আমরা ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেব যে কোন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে কিনা এবং তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি আনা হবে কিনা এটা আমরা প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে আমাদের কোন এফআইআর প্রয়োজন হয় না আমাদের তদন্ত সংস্থার কাছে যদি মনে হয় হ্যাঁ এই দলটি রাজনৈতিকভাবে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা দরকার তাহলে আইন অনুযায়ী তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং যা যা আইনের ব্যবস্থা আছে সেগুলো চলমান হবে।
চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি জুলাই গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত ২০ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় তিনবার বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিল প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় দুই মাস বাড়ানো হয়। আগামী ২৪ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন প্রসিকিউশনের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। অবশ্য এর আগেই প্রতিবেদন জমা দিল তদন্ত সংস্থা।
গত শুক্রবার এক ফেসবুক পোস্টে চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। জানা গেছে, প্রথমে শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলেও পরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা দুই মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত দুই মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এই মামলা ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। অপর মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলী, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বিচারে হত্যা চালায়। প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারায় এই আন্দোলনে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। এরপর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচার করার সিদ্ধান্ত নেয়।